জোটগত ভোট হলে পাল্টে যেতে পারে হিসাব

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসন নিয়ে স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। দলীয় প্রার্থী ঘিরে চলছে নানা হিসাব। মনোনয়ন পেতে প্রার্থীরা তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি কেন্দ্রের সঙ্গে লবিং-তদবিরে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। প্রার্থিতা জানান দিতে নানা কৌশলে নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন কোনো কোনো প্রার্থী। গতবার এ আসনে জোটগত নির্বাচন হয়। আগামী নির্বাচন একক নাকি জোটগতভাবে হবে তা নিয়েও বিশ্লেষণ চলছে। জোটগত নির্বাচন হলে সব হিসাব পাল্টে যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে এটি একটি ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে। গতবার আওয়ামী লীগ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এমএ মুনিম চৌধুরী বাবু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। আগামী নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। এখন থেকেই তিনি তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেকের নামই শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রয়াত সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর ছেলে দেওয়ান শাহনেওয়াজ গাজী মিলাদ, বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএমএর সভাপতি ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী, কানাডা প্রবাসী মেজর (অব.) সুরঞ্জন দাশ ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য আবদুল মুকিত চৌধুরীর নাম জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়ার নামও আলোচনায় রয়েছে। তবে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন ১/১১ সরকারের সময় তার ভূমিকা নিয়ে দলের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তার বাবা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হবিগঞ্জ সদর থেকে নির্বাচন করলেও তাদের বাড়ি নবীগঞ্জে। এ আসনে আওয়ামী লীগের মধ্যে কয়েকটি বলয় গড়ে উঠেছে। একটি ধারার নেতৃত্বে রয়েছেন বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বিএমএর সভাপতি ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী। শাহনেওয়াজ গাজী মিলাদের নেতৃত্বে সক্রিয় রয়েছে একটি গ্রুপ। সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী এবং নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরীর নেতৃত্বে আলাদা বলয় কাজ করছে এলাকায়। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন শাহনেওয়াজ গাজী মিলাদ। গতবার তিনিই দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয়ায় তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার বাবা এ এলাকা থেকে একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সুখে-দুঃখে সব সময় এলাকার মানুষের পাশে আছি এবং থাকব। বাবার মৃত্যুর পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। পরে নেত্রীর নির্দেশে আমি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেই। আমি আশাবাদী এবার নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দেবেন। এলাকাবাসীর প্রতি আমার বিশ্বাস রয়েছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নেত্রী যদি আমাকে দলীয় মনোনয়ন নাও দেন তারপরও আমি দলের জন্য কাজ করে যাব।’ কেয়া চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি হবিগঞ্জের জনগণের সেবায় ছিলাম, আছি এবং থাকব। জনগণের জন্য কাজ করছি বলেই এলাকার মানুষ আমাকে আগামী নির্বাচনে চাচ্ছেন। সংরক্ষিত আসনের এমপি নির্বাচিত হওয়ার দু’দিন পরই আমি এলাকায় ছুটে আসি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আমি এলাকা ছেড়ে কোথাও যাই না। নানা কর্মসূচি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সভা সমাবেশে এলাকার মানুষের সঙ্গেই আছি।
ভোটারদের সুখে-দুঃখে কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি জনগণের সঙ্গেই থাকতে চাই।’ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সুজাত মিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিএনপির সভাপতি শাহ মোজাম্মেল নান্টুর নাম শোনা যাচ্ছে। সুজাত ও নান্টু দু’জনই দেশের বাইরে থাকায় তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। এদিকে নবীগঞ্জে উপজেলা বিএনপির মধ্যে বিভক্তি বছর খানেক ধরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত বছর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভক্তি দেখা দেয়। বলাবলি হচ্ছে, এ কারণেই গত ইউপি নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি ঘটে। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ২০ ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই দখলে রাখে ১২টি। বাকিগুলোর মধ্যে বিএনপি ৩টি, জাতীয় পার্টি ১টি, স্বতন্ত্র ৪ চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচিত হন। এ ছাড়া এ আসনের দুই উপজেলায়ই আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হন। ফলে কোন্দলের বিষয়টি তৃণমূল বিএনপির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। নবীগঞ্জে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী ও বাহুবল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাই উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ভাইস চেয়ারম্যান পদে নবীগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা আশরাফ আলী ও বাহুবলে ইসলামী ঐক্যজোট নেতা শিহাব উদ্দিন শাকিব বিজয়ী হন। তবে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুটি উপজেলাতেই বিএনপি সমর্থিতরা বিজয়ী হন। এদিকে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে একজনের নামই জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। তিনি হচ্ছেন বর্তমান এমপি ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এমএ মুনিম চৌধুরী বাবু। জোটবদ্ধ নির্বাচন হলেও মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে তার মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি উজ্জ্বল বলে জানা গেছে। তবে জাতীয় পার্টির নেতা লন্ডন প্রবাসী আবদুল হামিদ চৌধুরীর সমর্থকরাও মাঠে সক্রিয়। তিনিও জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী। বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন দিবসে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সমর্থকরা আলাদা আলাদাভাবে তাদের প্রিয় নেতার নাম ও ছবিসংবলিত ব্যানার নিয়ে হাজির হতে দেখা যায়। ব্যানারে লেখা থাকে ‘হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে এমপি হিসেবে অমুককে চাই’। কথা হয় বর্তমান এমপি ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এমএ মুনিম চৌধুরী বাবুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দলে আমি একাই প্রার্থী। এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। গত ৪৩ বছরেও এমন উন্নয়ন হয়নি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিজয় আমার নিশ্চিত। সব সময় সাধারণ মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।’ হবিগঞ্জ-১ আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আবদুল আজিজ চৌধুরী, ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের আবদুল মান্নান চৌধুরী ছানু মিয়া, ১৯৭৯ সালে জাসদের মাহবুবুর রব সাদী, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের ইসমত আহমদ চৌধুরী, ১৯৮৮ সালে জাসদের অ্যাডভোকেট আবদুল মোচাব্বির চৌধুরী, ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টির প্রয়াত খলিলুর রহমান চৌধুরী রফি এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে এমপি হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত দেওয়ান ফরিদ গাজী। ২০০১ সালে তিনি ফের এমপি হন। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো ফরিদ গাজী এমপি হন। এর দু’বছর পর ২০১০ সালের ১৯ নভেম্বর দেওয়ান ফরিদ গাজী মৃত্যুবরণ করেন। পরে ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুর্গে প্রথম হানা দেয় বিএনপি প্রার্থী হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি শেখ সুজাত মিয়া। তিনি আসনটি বিএনপিকে উপহার দেন। উপনির্বাচনে বিএনপির এ বিজয় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ওই উপনির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী মাত্র ১২শ’ ভোটে পরাজিত হন। পরে ২০১৪ সালে মহাজোট গঠন হলে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়। এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন মুনিম চৌধুরী বাবু।

No comments

Powered by Blogger.