স্বতন্ত্র নীতিমালার অভাবে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

স্বতন্ত্র নীতিমালার অভাবে কোরবানির অস্থায়ী পশুর হাট থেকে বছরে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের চোখে ধরা পড়লেও রহস্যজনক কারণে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। ফলে প্রতিটি হাটের জন্য পাতানো দরপত্র আয়োজনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। প্রতিবছর সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণেই থাকছে কোরবানির অস্থায়ী পশুর হাট। ইজারাদার ও সংস্থার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা মিলেমিশে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কোরবানির অস্থায়ী এসব পশুর হাট ব্যবস্থাপনা করছে উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনগুলো। গত বছর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে অস্থায়ী ২২টি হাটের মোট ইজারামূল্য ওঠে ১৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে ইজারাদারদের সরবরাহকৃত তথ্যমতে, হাসিল আদায় হয় ৭৪ কোটি টাকা, যা ইজারামূল্যের চারগুণ। যদিও বাস্তব চিত্র আরও বেশি হবে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা। এবার ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অস্থায়ী হাটগুলোয় পশু বিক্রি থেকে সম্ভাব্য হাসিল আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩৮ কোটি টাকা। অথচ অস্থায়ী ২২টি পশুর হাটের ইজারা মূল্য উঠেছে মাত্র ২৩ কোটি টাকা। হাসিল এবং ইজারামূল্যের ফারাক বিস্তর। অল্প সময়ে বিপুল অর্থের বাণিজ্য করার স্বার্থে ইজারাদার, রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশের কারণে অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাট ইজারার স্বতন্ত্র নীতিমালা হচ্ছে না বলে অভিযোগ মিলেছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহুল ইসলাম প্রায় একই কথা বলেন। তারা আলাদাভাবে যুগান্তরকে বলেন, অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাট ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। এ কারণে স্থানীয় সরকার বিভাগের সরকারি হাটবাজারগুলোর ব্যবস্থাপনা, ইজারা পদ্ধতি এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত আয় বণ্টন সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১১ অনুসরণ করে অস্থায়ী কোরবানির হাট পরিচালনা করা হচ্ছে। অস্থায়ী কোরবানির হাট ব্যবস্থাপনার জন্য সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলব। যুগান্তরের অনুসন্ধানে সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অস্থায়ী কোরবানির হাট ইজারা দর ও হাসিল আদায়ের বাস্তব চিত্র বিশ্লেষণ করলে বিস্তর ফারাক ধরা পড়ে। বেরিয়ে আসে স্বতন্ত্র নীতিমালা প্রয়োজনীয়তার বিষয়। আর এটা অকপটে স্বীকারও করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে স্বতন্ত্র নীতিমালা প্রণয়নে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন বা অন্য কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে কখনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। জানা যায়, সরকারি হাটবাজারগুলোর ব্যবস্থাপনা, ইজারা এবং অর্থ বণ্টন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ‘সরকারি হাটবাজারগুলোর ব্যবস্থাপনা, ইজারা পদ্ধতি এবং প্রাপ্ত আয় বণ্টন সম্পর্কিত-২০১১ সালের নীতিমালার আলোকে। এছাড়া ২০১৬ সালে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে এ সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ওই পরিপত্রে বলা হয়েছে, বিদ্যমান নীতিমালার সবকিছু অক্ষুণœ রেখে প্রতি তিন বছর অন্তর ঢাকার স্থায়ী হাটগুলোর ২৫ শতাংশ দাম বাড়াতে হবে। ঢাকার বাইরের হাটগুলো ১০ শতাংশ দাম বাড়াতে হবে। অস্থায়ী হাট ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিদ্যমান নীতিমালার ১০ এর ২-এ বলা হয়েছে, স্থায়ী হাটবাজার বাদে যদি ঈদ বা অন্য কোনো বিশেষ উপলক্ষে হাটবাজার, মেলা বসানোর প্রয়োজন পড়ে, তবে সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন বা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা জেলা প্রশাসকের পূর্ব অনুমোদনক্রমে স্থায়ী হাট ব্যবস্থাপনা নীতিমালার বিধিবিধান (যতদূর সম্ভব) অনুসরণ করে অস্থায়ী হাট ইজারা দেবেন। আর ইজারালব্ধ অর্থের ২০ ভাগ অর্থ ৭ ভূমি রাজস্ব ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ইজরা প্রদান করবে। অবশিষ্ট অর্থ সংশ্লিষ্ট উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনের আয় হিসেবে গণ্য হবে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট, কোরবানির পশুর হাট সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, নির্ধারিত স্থানে পশু জবাই নিশ্চিতকরণ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে বর্জ্য অপসারণ সংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করছে। এ ইউনিটের কাছে দুই সিটি কর্পোরেশনের দেয়া তথ্যমতে, এবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) হাটগুলোয় পশু জবাইয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার গরু এবং ২৫ হাজার ছাগল।
আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ গরু এবং ২১ হাজার ছাগল। পশু ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, ছোটবড় মিলিয়ে এবার প্রতিটি গরুর গড়মূল্য হবে সর্বনিন্ম ৬০ হাজার টাকা এবং প্রতিটি ছাগলের গড়মূল্য হবে সর্বনিন্ম ১০ হাজার টাকা। আর প্রতিটি গরু ও ছাগল থেকে শতকরা ৫ টাকা করে হাসিল আদায় করবে হাট ইজারাদাররা। সেই হিসাবে ডিএসসিসি এলাকার হাটগুলোর গরু বিক্রি করে হাসিল আদায় হবে অন্তত ৭৫ কোটি টাকা। আর ছাগল বিক্রি করে হাসিল আদায় হবে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ডিএনসিসি এলাকার হাটগুলো থেকে গরু বিক্রি করে হাসিল আদায় হবে ৬০ কোটি টাকা। ছাগল বিক্রি করে হাসিল আদায় হবে অন্তত ১ কোটি ৫ লাখ টাকা। এবার সর্বমোট হাসিল আদায় হবে ১৩৮ কোটি টাকা। আর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ২২টি হাটের এবারের ইজারামূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে কমপক্ষে ১১৫ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে সরকার। অস্থায়ী কোরবানি পশুর হাটের দরপত্র প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ার পেছনের অন্যতম কারণ হচ্ছে- ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাব এবং টেন্ডার সমঝোতা। আর এ কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে শাসক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হাটে কোনো আবেদন জমা পড়ে না। সবকিছু সম্ভব হচ্ছে অস্থায়ী হাটবাজার বা মেলা ব্যবস্থাপনার স্বতন্ত্র নীতিমালার অভাবে। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, জনস্বার্থে কোনো নীতিমালা সংশোধন বা প্রণয়ন করা প্রয়োজন হলে অবশ্যই সেটা করা হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে প্রয়োজনে আমরা আলাপ-আলোচনা করব। তাছাড়া ওই সংস্থার প্রতিনিধিরা বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.