মনোবল হারায়নি সিদ্দিকুর

চেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একদিন পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবেন। সে লক্ষ্য পূরণেই গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলেন তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান। কিন্তু পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেল সবকিছু ওলটপালট করে দিল। কেড়ে নিয়েছে দৃষ্টিশক্তি, কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি মানসিক শক্তি। সিদ্দিকুর আগের মতোই শক্ত আছেন। এ অবস্থাতেও লেখাপড়া শেষ করে দায়িত্ব নিতে চান পরিবারের। শনিবার যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত আলাপে এসব কথা জানিয়েছেন সিদ্দিকুরের মা সুলেমা খাতুন। সিদ্দিকুর ভারতের চেন্নাইয়ে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে শুক্রবার দেশে ফিরে আসেন। এরপর তাকে পুনরায় নেয়া হয় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে। এখন তিনি সেখানেই আছেন। অশ্রুসজল চোখে সিদ্দিকুরের মা বলেন, শুক্রবার ভারত থেকে ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে সিদ্দিকুর বলে, তুমি চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। চোখে দেখতে না পারলেও আমি লেখাপড়া শেষ করব, নিজের পায়ে দাঁড়াব। তোমাদের আর কষ্ট থাকবে না। সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে স্থায়ী চাকরি দেয়ার কথা বলেছে। আমার চাকরি হলে আর কাউকে কষ্ট করতে হবে না। সুলেমা খাতুন জানান, সিদ্দিকুর তার ছোট সন্তান। পরিবারে অভাব-অনটন থাকায় সে কখনও কোনো দাবি-দাওয়া করেননি। কারও দায়া-অনুগ্রহ চাননি। সব সময় শুধু লেখাপড়া করতে চেয়েছেন। পরিবারের অভাব-অনটন দূর করতে চেয়েছেন।
নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালানোর চেষ্টা করেছেন। এখনও সে কারও বোঝা হতে চান না। সিদ্দিকুরের মা বলেন, সরকার আমার ছেলের চিকিৎসায় অনেক করেছে। আমাদের আর কিছু বলার নেই। তবে উন্নত বিশ্বের কোথাও যদি চিকিৎসার মাধ্যমে সিদ্দিকুরের চোখ ভালো করা সম্ভব হয়, তাহলে সেই চেষ্টাটুকু যেন করা হয়। প্রয়োজনে পরিবারের কারও চোখ দান করতে হলেও সমস্যা নেই। চোখের এ অবস্থা নিয়েও সিদ্দিকুর লেখাপড়া শেষ করতে চায়, সেই সুযোগটুকু যেন তাকে দেয়া হয়। আর তাকে যেন একটি স্থায়ী কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। সিদ্দিকুরের বন্ধু নোমান ও শাহ আলী জানান, শুক্রবার ভারত থেকে ঢাকায় আসার পর থেকেই তার ডায়রিয়া শুরু হয়। শনিবার সকাল ৯টার দিকে চিকিৎসকরা কয়েক দফা তার চোখের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এরপর তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। বন্ধুরা জানান, চেন্নাই থেকে আসার পর সিদ্দিকুরকে হাসপাতালের ভিআইপি কেবিন-৩-এ রাখা হয়েছে। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই তার চিকিৎসা চলবে। বন্ধুদের সঙ্গে রাতে সিদ্দিকুর নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। এর মধ্যে দুটি বিষয়ে তার গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি- লেখাপড়া শেষ করা এবং চাকরি বা কাজের সংস্থান। তিনি যে কোনোভাবে লেখাপড়া শেষ করতে চান। এমনকি অন্ধদের মতো ব্রেইল পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিতে হলেও। আর সরকারের পক্ষ থেকে তাকে যে কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে, সেটা যেন অবশ্যই সম্মানজনক হয়। সেই কর্মসংস্থানের আয় থেকে যেন তিনি তার পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন। সিদ্দিকুরের চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, এখন ফলোআপ চিকিৎসা চলছে। অস্ত্রোপচারের পর সব রোগীকেই ফলোআপ করা হয়। তার জন্য নতুন করে মেডিকেল বোর্ড করা হয়েছে। বোর্ডের অধীনেই চিকিৎসা চলবে। কতদিন ফলোআপে রাখতে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা নির্ধারিত নয়। যতদিন প্রয়োজন তাকে এখানে রেখে চিকিৎসা দেয়া হবে। তার বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। এদিকে আজ বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেছেন সিদ্দিকুরের বন্ধুরা। অনার্স তৃতীয় বর্ষের নির্বাচনী পরীক্ষার পর আট মাস পেরিয়ে গেলেও চূড়ান্ত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবি জানাতে গিয়েই চোখ হারাতে হয়েছে সিদ্দিকুরকে। তাছাড়া আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। মামলা প্রত্যাহার, পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা এবং হামলাকারী পুলিশদের শাস্তির দাবিতে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। প্রসঙ্গত, ভারতে উন্নত চিকিৎসা শেষে শুক্রবার বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে মালদ্বীপ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন সিদ্দিকুর। তার ফিরে আসা উপলক্ষে ওইদিন দুপুর থেকেই বিমানবন্দর এলাকায় চোখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ জানান তার বন্ধুরা। ২০ জুলাই পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণার দাবিতে শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের সময় ‘পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলের’ আঘাতে সিদ্দিকুরের দুই চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটনার পর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার পর সরকারি ব্যবস্থাপনায় ২৭ জুলাই ভারতের চেন্নাইয়ের শঙ্কর নেত্রালয়ে নেয়া হয় সিদ্দিকুরকে।

No comments

Powered by Blogger.