বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার নতুন সম্পর্ক সম্ভাবনার দিগন্ত স্পষ্ট হয়েছে

বাংলাদেশে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে শনিবার ফিরে গেছেন শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। তার সফরকে ঘিরে বেশ আগ্রহ-উদ্দীপনা দেখা গেছে ঢাকায়। বিশেষ করে বিভিন্ন মিডিয়ার ইতিবাচক ও সরব খবর প্রকাশের পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে এ সফরকে বেশ গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে। আমাদের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ খোদ বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়ে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী-কর্মকর্তারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বাণিজ্য-বিনিয়োগ বিষয়ক সেমিনারে উপস্থিত হয়েছেন সিরিসেনা। দ্বি-পাক্ষিক স্বার্থ ছাড়াও তার সফরে বন্ধুসুলভ যে কূটনৈতিক সৌজন্য দেখান হয়েছে তাকে আমি ইতিবাচকই বলব। কারণ শ্রীলংকা কেবল আমাদের নিকট প্রতিবেশীই নয়, এ অঞ্চলের পারস্পরিক যোগাযোগের যে সংগঠন সার্ক রয়েছে, তারও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশটি। সিরিসেনার এ সফরে ১৪টি চুক্তি ও সমঝোতা (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে সাসটেনটিভ বিবেচনায় সরকারি কর্মকর্তাদের বিনা ভিসায় শ্রীলংকা সফরের বিষয়টি ইতিবাচক শুভেচ্ছার নিদর্শন ধরে নেয়া যায়। এতে কাজের ক্ষেত্রে সহজে ও দ্রুততম সময়ে দ্বীপ দেশটিতে আমাদের কর্মকর্তারা আসা-যাওয়া করতে পারবেন। একই সুযোগ পাবেন শ্রীলংকার কর্মকর্তারাও। বিষয়টি পারস্পরিক সম্পর্কের গতি সঞ্চার করবে। এছাড়া ১৩টি এমওইউর মধ্যে শিক্ষা, বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত না বললেও শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টের সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও আরও শক্তিশালী হয়েছে। পারস্পরিক সমঝোতা-সম্পর্ককে টেকসই রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে এটা ইতিবাচকই বার্তা বয়ে এনেছে। যার মধ্যে দুই-তিনটি বিষয় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও গভীর করবে। উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি এখনই স্বাক্ষরিত না হলেও বিষয়টিতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। শ্রীলংকা চীনের সহায়তায় কলম্বো বন্দরের উন্নয়নের কাজ করছে। একে সিঙ্গাপুরের বিকল্প ট্রানজিট বন্দর হিসেবে আমরা ব্যবহার করার সুযোগ পাব। যদি কলম্বো বন্দর যথেষ্ট আধুনিক ও আর্থিকভাবে আকর্ষণীয় হয়, তবে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এটিকে বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে আমাদের জন্য । আরেকটা বিষয়, এ সফরে ভবিষ্যৎ অমিত সম্ভাবনার দ্বার নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের সামনে। সেটা হল এফটিএ বা মুক্তবাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি। এখনই স্বাক্ষরিত না হলেও এ বছরের মধ্যেই এটি স্বাক্ষরিত হওয়ার বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশ আশাবাদী হলেও এবং আলোচনা চালিয়ে গেলেও এখনও কোনো দেশের সঙ্গে এমন চুক্তি হয়নি। এক্ষেত্রে শ্রীলংকাই আমাদের আগ্রহী করছে। এতে দুই কারণে বাংলাদেশের অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এক. এখনও কারো সঙ্গে এমন চুক্তি আমাদের হয়নি। শ্রীলংকাই হতে যাচ্ছে এফটিএ বা মুক্তবাণিজ্যের চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রথম সঙ্গী। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ও মুক্তবাণিজ্যের নতুন কাঠামো আমাদের তৈরি হবে। দুই. শ্রীলংকা ভারতের সঙ্গে ১২ বছরের বেশি সময় ধরে মুক্তবাণিজ্য নিয়ে কাজ করছে। শ্রীলংকার সঙ্গে চুক্তির মধ্য দিয়ে এর সুবিধা-অসুবিধা আমরা বুঝতে পারব, যা আমাদের জন্য ইতিবাচক হবে। ভারতের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কী সুবিধা, কী অসুবিধা তা-ও আমরা জানতে পারব। ফলে নেপাল-ভুটানসহ অন্য আগ্রহী দেশগুলোর সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের চুক্তির সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। এটি আমাদের দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একটি কথা, এক দশক ধরে আলোচনা চললেও এখনও আমরা কোনো পদক্ষেপ নেইনি মুক্তবাণিজ্যের। কিন্তু নতুন বিশ্বে নতুন কাঠামো আসবে, সেটা আমাদের ভাবতে হবে। মুক্তবাণিজ্যের সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো শিখতে হবে। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টের সফরের মধ্য দিয়ে কেবল চুক্তি নয়, আগামী দিনের বিশ্ববাণিজ্য কাঠামোতে যে পরিবর্তন আসবে সেটার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে আমরা সাহস পাব ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাব। তৃতীয় বিষয়টি বাণিজ্যিক নয়, পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক। আমরা জানি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে শ্রীলংকা। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত এবং একই সঙ্গে চীনের সঙ্গেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে কলম্বো। এটা তারা কীভাবে করছে তা আমাদের জানা দরকার। কারণ আমরা এমন একটা জায়গায় আছি যেখানে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ও যোগাযোগ আছে। একই সঙ্গে আরেক পরাশক্তি চীনের সঙ্গে যোগাযোগ-নিরাপত্তা ইস্যুগুলোকে কাজে লাগানোর প্রয়োজন আছে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ দুই দেশের (ভারত-চীন) উপস্থিতি কাজে লাগাতে পারে, যা শ্রীলংকার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখতে পারব। বাংলাদেশ-শ্রীলংকা পরস্পর এখান থেকে উপকৃত হতে পারে। ট্যুরিজম বা পর্যটনে শ্রীলংকা ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ভারত ও চীনের পর্যটকদের টানতে পারে। কারণ দেশ দুটির সঙ্গে আমাদের জনগণ, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ রয়েছে। এ সফরে আলোচনা না হলেও আমাদের পর্যটন খাতকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হলে শ্রীলংকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশ-শ্রীলংকার বিরাজমান সম্পর্ককে কাজে লাগাতে হলে দেশের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক সুযোগ ও সম্পর্ককে ভালোভাবে ব্যবহার করতে হবে। এভাবে অনেক ইতিবাচক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।
হুমায়ন কবীর : সাবেক কূটনীতিক

No comments

Powered by Blogger.