ফ্রান্সে নতুন ইতিহাসের সূচনা

ফ্রান্সের রাজনীতিতে এক বছর আগেও খুব একটা পরিচিত ছিলেন না এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনিই এখন দেশটির প্রেসিডেন্ট। দেশটির দিগি¦জয়ী বীর নেপোলিয়ান বেনাপার্টের পর সবচেয়ে তরুণ নেতা ম্যাক্রোঁ। নিজের ৪০তম জন্মদিনের কয়েক মাস আগেই রোববার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইতিহাসের এ বরপুত্র। ভেঙে দেন ফ্রান্সের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রায় ৬০ বছরের গতানুগতিক ধারা। দেশের মূলধারার মধ্য-ডানপন্থী ও মধ্য-বামপন্থী দলকে পেছনে ফেলে জয়ী হয়েছেন ম্যাক্রোঁ। খবর বিবিসি ও এএফপির। এক বছর আগেও তার নিজের কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। সরকারি পদ ছেড়ে ২০১৬ সালে রাজনৈতিক দল ‘এন মার্শে! (এগিয়ে চলো) গঠন করেই বাজিমাত করলেন ম্যাত্রেঁদ্ধঁ। সাবেক ব্যাংকার ম্যাক্রোঁ ফরাসি রাজনীতির প্রজন্ম বদলের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটান। জি-৭ দেশগুলোর নেতাদের মধ্যেও এখন ম্যাক্রোঁই সবচেয়ে তরুণ নেতা। এসব দেশের সব নতুন-পুরনো তরুণ নেতার চেয়েও তিনি তরুণতর, এমনকি কানাডীয় প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডোই হোন আর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হোন। ১৮০৪ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ফ্রান্সের সম্রাট হন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। রোববারের নির্বাচনে ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন ম্যাক্রোঁ। তার প্রতিদ্বন্দ্বী লি পেন পান ৩৫ শতাংশ ভোট। এরপরই রাজধানী প্যারিসে ল্যুভর জাদুঘরের সামনে সমর্থকদের উদ্দেশে বিজয়ী বক্তব্য দেন তিনি। ‘নতুন করে ইতিহাস গড়ার’ প্রত্যয়ের কথা জানিয়ে ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘এ রাতে আমরা জিতেছি। ফ্রান্স জিতেছে। অনেকেই বলেছিলেন এ জয় অসম্ভব। কিন্তু তারা ফ্রান্সকে আর ফরাসিদের চিনতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদের শক্তি, সামর্থ্য এবং ইচ্ছা আছে। আমরা সবাই মিলে দেশকে বদলে দেব। বিভাজন ভুলে, পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে আজ থেকে নতুন ইতিহাসের সূচনা হবে।’ ফ্রান্সের অভিজাত ন্যাশনাল স্কুল অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গ্রাজুয়েট মাত্রেঁদ্ধা। এই স্কুল থেকেই ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারা বের হয়ে আসেন।
এর সাবেক ছাত্রদের মধ্যে ম্যাক্রোঁসহ ফরাসি প্রেসিডেন্টের সংখ্যা চার জনে দাঁড়ালো। জীবনের সব ক্ষেত্রেই ম্যাক্রোঁ সিরিয়াস ছিলেন এবং নিজেকে লক্ষ্যের পথে পরিচালিত করেছেন। পড়েছেন দর্শন। কাজ করেছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক পল রিকোরের সহযোগী হিসেবে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন স্কুলের সমাপনী পরীক্ষায় সাফল্যের সুবাদে তিনি ফ্রান্সের অর্থ মন্ত্রণালয়ে ফিনান্সিয়াল ইন্সপেক্টর হিসেবে নিয়োগ পান। এখানে থাকার সময় ম্যাক্রোঁর এক সতীর্থ তাকে প্রশ্ন করেন, ‘৩০ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চাও?’ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট- জবাব দিয়েছিলেন ম্যাক্রোঁ। তবে তার আগেই সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন করলেন তিনি। ২০১৪ সালে সমাজতান্ত্রিক সরকারের অর্থ, শিল্প ও ডিজিটাল অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ম্যাক্রোঁ। ব্লন্ড চুল ও নীল চোখের ম্যাক্রোঁকে কাছের মানুষেরা ‘মানু’ নামেই ডাকেন। স্কুলে পড়ার সময় বরাবরই ক্লাস থেকে দেরি করে বেরোতেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষকের সঙ্গে গল্প করা। ফরাসি সাহিত্য ও নাট্যকলার শিক্ষক ব্রিজিত ত্রগনিয়ক্স প্যারিসের একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াতেন। স্কুলের অনুষ্ঠানের জন্য ড্রামা রচনার কাজে মানু তার শিক্ষকের সঙ্গে কাজটি করেন। একপর্যায়ে ম্যাক্রোঁ শিক্ষককে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তা নাকচ করেন। ১৫ বছর বয়সী ম্যাক্রোঁর সমবয়সী এক মেয়ে ছিল তার। এক ক্লাসেই পড়ত তারা। তবে নাছোড়বান্দা ম্যাক্রোঁ পরিণত বয়সেই তার চেয়ে ২৬ বছরের বেশি বয়সী সেই শিক্ষককেই বিয়ে করেন। বর্তমানে ৬৩ বছর বয়সী স্ত্রী ব্রিজিতের সাতজন নাতি-নাতনি রয়েছে। প্রথম পর্বের ভোটে জয়ের পর এক অনুষ্ঠানে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে স্মিত হাস্যে ম্যাক্রোঁ বলেছিলেন, ‘ব্রিজিত সব সময় আমার পাশে আছে। তার চেয়ে বড় বিষয়, তাকে ছাড়া আমি আজকের আমি হয়ে উঠতে পারতাম না।’

No comments

Powered by Blogger.