দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ‘ধর্ষণ’ - ওরা কেউ ধরা পড়েনি

রাজধানীর বনানীতে দি রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণের অভিযোগের পর মামলা দায়ের হতে লেগেছিল তিন দিন। এখন গতকাল মামলার দ্বিতীয় দিন পার হলেও গ্রেপ্তার হয়নি ধনীর দুলালরা। গতরাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত অধরা ৫ আসামির সবাই।
তবে প্রভাবিত হয়ে আসামি গ্রেপ্তারে অনীহার কথা অস্বীকার করেছে পুলিশ। আসামিরা যাতে বিদেশে পালাতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে বলেও জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। এদিকে ঘটনাটিকে ধর্ষণের নামে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে দাবি করছে আসামির স্বজনরা। ওই ঘটনা তদন্তে গতকাল ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। গতকাল দুই তরুণী ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে বাসায় ফিরে গেছেন।
মামলার বাদী মানবজমিনকে বলেন, একজন নারী হিসেবে সমাজে কখন ধর্ষিতা হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করে। ব্ল্যাকমেইলের হুমকির পর তারাই সে বিষয়টি প্রকাশ করে দেয়া ও ভয়ভীতি দেখানোর পর আমরা বাধ্য হয়ে জানিয়েছি। মামলা করেছি। আপনারা তাদের জিজ্ঞেস করুন। দেখুন তারা কী বলে। আমরা ধর্ষণের বিচার চাই। আর যাতে কেউ তাদের শিকার না হয়। মামলার তদন্তে দায়িত্বে থাকা বনানী থানার  পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ  আবদুল মতিন মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ প্রভাবিত হয়নি। কোন অনীহাও নেই। তদন্ত চলছে। ফরেনসিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে ধর্ষণের বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ধর্ষিতারা সাফাতের ডিভোর্স পাওয়া স্ত্রীকে নিয়ে থানায় মামলা করতে এসেছিল। সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তে যা উঠে আসবে সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেয়া হবে। আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে দাবি করলেও মামলার তদন্তের স্বার্থে এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
মামলার অভিযোগ ও ভিকটিম সূত্রে জানা যায়, গত ২৮শে মার্চ দিবাগত রাতে সাফাত আহমেদের জন্মদিনের পার্টিতে দাওয়াতের কথা বলে ওই দুই তরুণীকে সেই হোটেলে নেয়া হয়। সাফাত স্বনামধন্য আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে। এরপর সেখানে পার্টি তো দূরের কথা, তেমন লোকজনও ছিল না। পরে ওই হোটেলের ৯ তলার ছাদ থেকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হোটেল কক্ষে নিয়ে ওই দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ সাফাত ও তার বন্ধু আরেক ধনীর দুলাল নাঈম আশরাফের বিরুদ্ধে। আর ওই দুই ছাত্রীকে ডেকে নেয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা ছিল দুই বছর ধরে দুই বান্ধবীর পরিচিত বন্ধু সাদমান সাকিফের। সাদমান সাকিফ অপর এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর ছেলে। বাকি দুই আসামি সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও বডিগার্ড। সাফাত ও নাঈম ধর্ষণদৃশ্যের ভিডিওচিত্র ধারণ করে তাদের বারবার ধর্ষণের সুযোগ নেয়ার জন্য ব্ল্যাকমেইল করেছিল। ঘটনার কথা কাউকে বললে খুন ও গুমের হুমকি দিয়েছিল। ঘটনার পর কথামতো তারা সেই ভিডিও’র কথা বলে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করলে একপর্যায়ে তারা তা স্বজনদের জানাতে বাধ্য হয়। থানায় যায়। মামলা করে।
এদিকে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। আগামী ১৫ দিনে মধ্যে ওই কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা তদন্ত শুরু করেছি। ইতিমধ্যে মিডিয়ায় অনেক কিছু প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও আমরা ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বলেছি। আজকেই (সোমবার) আমরা পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। এ ঘটনা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তদন্ত শেষে পুরো বিষয়টা নিয়ে আমরা কথা বলবো। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে নজরুল ইসলামকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন নুরুন নাহার ওসমানী, এনামুল হক চৌধুরী, শরীফ উদ্দীন ও এম রবিউল ইসলাম।’
তদন্ত কমিটি প্রয়োজনীয় স্থান পরিদর্শন, সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে বলেও জানায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনার।
আসামিদের বিদেশে পালানো ঠেকাতে ‘সতর্ক’ পুলিশ: দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণে জড়িতদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে সতর্ক রয়েছেন বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আসামিদের গ্রেপ্তারে বনানী থানা পুলিশের সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিবির উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম। তারা মামলাটির ছায়াতদন্ত করছে বলেও জানান। তবে এখনো কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।
বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আসামিদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে আসামিরা কোথায় আছে, তা বলা যাবে না। তবে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে।’
অপরাধীরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন তাদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়ে নাজমুল বলেন, ‘আসামিরা যাতে দেশ ছাড়তে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।’ এখন পর্যন্ত কোনো আসামির দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য পুলিশের কাছে নেই বলে জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
এদিকে ধর্ষণকারী হিসেবে উল্লেখ করা সাফাত ও নাঈম প্রভাবশালী দুই ধনীর দুলাল। অপর সহযোগী সাকিফও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর ছেলে। বাকি দুজন সাফাতের গাড়িচালক ও বডিগার্ড। সাফাতকে গ্রেপ্তারে গুলশান-২-এর বাসায় বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। সাফাত, নাঈম, সাদমান এবং ঢাকার একজন সংসদ সদস্যের ছেলে বনানী ১১ নম্বর সড়কে একটি রেস্তোরাঁ চালান। এছাড়া তাদের একাধিক সীসাবারও রয়েছে।
যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সাফাত ও নাঈমের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। সাফাতের পিতা দিলদার আহমেদের মুঠোফেনে কল ও এসএমএস দেয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.