সামাজিক অস্থিরতায় বাড়ছে অপরাধ

বিভিন্ন কারণে সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে, বাড়ছে অপরাধপ্রবণতাও। খবরের কাগজ উল্টালেই চোখে পড়ছে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, ইভটিজিং, খুন, সন্ত্রাসবাদ, ছিনতাই, রাহাজানি আর বিবিধ অপরাধের খবর। সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ সামাজিক অস্থিরতা।
পারিবারিক কলহ
পরিবার আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম মূল ভিত্তি। এ সময়টায় বিভিন্ন কারণে পারিবারিক কলহের ঘটনা বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে পরিবারের এক সদস্যের হাতে আরেক সদস্যের খুন হওয়ার ঘটনা। স্বামী-স্ত্রীর কলহের জেরে প্রাণ দিতে হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুদের। পারিবারিক কলহের কারণে পরিবারের সবাই একসঙ্গে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। মানুষ এখন শুধু ঘরের বাইরেই নয়, তার আপনজনদের কাছেও নিরাপদ নন। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ বিভাগের তথ্যানুযায়ী বছরে মোট হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৪০ শতাংশ সংঘটিত হচ্ছে পারিবারিক কলহের কারণে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অনটন, অর্থের প্রতি প্রবল দুর্বলতা, চাওয়া পাওয়ার অসঙ্গিতর কারণে দাম্পত্য কলহ ও স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা, অন্য দেশের সংস্কৃতির আগ্রাসন, স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা, বিষণœতা ও মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে খুনের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে,
দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ জন। আর এর অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে। মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামাল জানান, সমাজে কেউ অপরাধী হয়ে জন্ম নেন না। মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে। বেশিরভাগ সময়ে সে পরিবেশ তার কাছের মানুষরাই তৈরি করে দেয়। কখনও কখনও সমাজে মানুষদের আচরণ, অসহযোগিতার কারণে পরিবারে, সমাজে দ্বন্দ্ব সংঘাতের মাত্রা বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক যন্ত্রণা বা মনোকষ্টে ভুগলে এসব হতে পারে। এ জন্য কাউনসিলিং দরকার। প্রত্যেককে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। সামগ্রিক সামাজিক অস্থিরতা, সন্তানকে নিয়ে অতিমাত্রার উৎকণ্ঠা, পারিবারিক কলহ, সবকিছু নিয়ে মানুষ অধৈর্য হয়ে পড়েছে। এগুলো প্রাকৃতিক কিছু নয়, এগুলো মানুষ দ্বারাই সৃষ্ট। এ জন্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক সচেতনতা ও সম্প্রীতি বাড়াতে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।
শিশু ও গৃহকর্মী নির্যাতন
হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েশিশুরা জীবন ও জীবীকার প্রয়োজনে গ্রাম থেকে শহরে আসে একটা কাজ পাওয়ার আশায়। ঢাকা শহরের বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেয় তারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব শিশু গৃহকর্মী গৃহকর্তা অথবা গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনের শিকার হতে থাকে দিনের পর দিন। এমনকি বাবা-মায়ের সঙ্গেও তাদের দেখা করতে দেয়া হয় না। নির্যাতনের কারণে কিছু অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। আবার কেউ কেউ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যারও চেষ্টা করে। কেউ পালিয়ে যায় বাঁচার তাগিদে। চলতি মাসেই (৫ মে) রাজধানীর মিরপুরে দিপালী আক্তার ফাতেমা (৮) নামে এক গৃহকর্মীকে গরম পানি দিয়ে ঝলসে দেয়ার ঘটনায় গৃহকর্ত্রী আয়শা বেগমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গৃহকর্মী ফাতেমার বাবা অটোরিকশা চালক সিরাজুল ইসলাম জানান, ২ মে দুপুরে ফাতেমার কাছ থেকে একটি কাচের গ্লাস ভেঙে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রান্না ঘরে ফাতেমার গায়ে গরম পানি ঢেলে দেন গৃহকর্ত্রী আয়শা। পরে ফাতেমাকে স্থানীয় শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক সোহান জানান, শিশুটির দেহের ৬ শতাংশ (দুই হাত,
মাথা ও পেটের কিছু অংশ) ঝলসে গেছে। পত্রিকার পাতা খুললেই অহরহ গৃহকর্তা, গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মী মেয়েশিশুর নির্যাতনের করুণ ঘটনা চোখে পড়ে। অথচ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার অনুচ্ছেদ ২৩, ২৪ ও ২৫-এ সব শ্রমিকের কাজের জন্য ন্যায়সঙ্গত মজুরির বিনিময়ে স্বাধীনভাবে কর্ম নির্বাচন, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, সাময়িক ছুটিসহ বিশ্রাম ও বিনোদন, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাস, পরিবারসহ মানবিক মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মাল্টিসেক্টর প্রোগামের প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন বলেন, গৃহকর্মী মেয়েশিশু কে কোথায়, কার বাড়িতে কাজ করছে এ সম্পর্কে পুলিশের কাছে একটি ডাটাবেইজ থাকলে, কোনো গৃহকর্মী মেয়েশিশু গৃহকর্তা, গৃহকর্ত্রী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হলে তাকে সুরক্ষা দেয়া সহজ হতো। অন্যদিকে গৃহকর্মী মেয়েশিশু গৃহকর্তার কোনো ক্ষতি করলে সেটা জানাও পুলিশের জন্য সুবিধা হতো। এক্ষেত্রে পুলিশ কর্তৃপক্ষের গৃহকর্মী মেয়েশিশুদের সুরক্ষায় দ্রুত একটি ডাটাবেইজ করা প্রয়োজন।
বাজার দরে অস্থিরতা
প্রতি বছরের মতো এবারও রমজান মাস সামনে রেখে বাজারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাজারে সব পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা সরবরাহ ঘাটতি, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, হাওর অঞ্চলে ফসলহানিসহ নানা অজুহাতে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছেন। রমজান শুরুর দুই সপ্তাহ আগেই চালের বাজার পুরোপুরি লাগামহীন হয়ে পড়েছে। চিনির বাজারেও অস্থিরতা। বাজারে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। রমজানে সারা দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের যে চাহিদা রয়েছে সে তুলনায় মজুদের পরিমাণ যথেষ্ট সন্তোষজনক। রমজানে চাহিদা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আড়াই লাখ টন করে সয়াবিন তেল ও চিনি, ১৫ হাজার টন খেজুর, ৫০ হাজার টন ডাল ও তিন লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। গত সপ্তাহে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন,সব পণ্যের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে এবং তা অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি। সুতরাং সরবরাহে ঘাটতির যুক্তি দেখিয়ে দাম বাড়ানোর কোনো কারণ নেই। টিসিবির তথ্য মতে, বর্তমানে মানভেদে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা কেজি, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ১১ টাকা বা ৩১.৮২ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো মানের ছোলা প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ ডলারে। এই দর দীর্ঘদিন ধরে খুব একটা ওঠানামা করেনি। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বর্তমান সময়ে ছোলা বিক্রি হচ্ছে অনেকটা বেশি দামে। টিসিবির তথ্যমতে, কেজিতে এই বৃদ্ধির পরিমাণ ৮ শতাংশ। পাইকারি ও খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খোলাবাজারে চিনির দাম বেড়ে গেছে। পাইকারি বাজারে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চিনিতে বেড়েছে প্রায় ৪০০ টাকা। অথচ স্থিতিশীল রয়েছে অপরিশোধিত চিনির পাইকারি বাজার। এদিকে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০৬ টাকায়। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল সর্বোচ্চ ৯৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে দুই দফায় ১১.৩৫ শতাংশ দাম বাড়ান হয়েছে। আর পাঁচ লিটারের ক্যানে এক বছরে দাম বেড়েছে ১৪.১২ শতাংশ। গরুর মাংস গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮.২৯ শতাংশ এবং খাসির মাংস ২২.৭৩ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। দেশের বাজারে মাংসের দাম কমার কোনো রেকর্ড নেই, প্রতিবছর এক-দুবার করে বাড়তে বাড়তে এখন গরুর মাংস ৫০০ ও খাসির মাংস ৮০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বাজারের এই অস্থিতিশীলতা মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্ত মানুষের জীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে অপরাধপ্রবণতা
ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে অপরাধ করা হয় তাকেই ‘সাইবার ক্রাইম’ বলা হয়। উন্নত বিশ্বে সাইবার অপরাধকে অপরাধের তালিকায় ইতিমধ্যেই শীর্ষে স্থান দেয়া হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে বহুল আলোচিত কয়েকটি সাইবার ক্রাইম হল- সাইবার পর্নোগ্রাফি, হ্যাকিং, স্প্যাম, অ্যাকশান গেম ইত্যাদি। বিশ্বের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশেও এখন সাইবার ক্রাইম সংঘটিত হতে শুরু হয়েছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে এ যুগে হাত বাড়ালে ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে পুরো পৃথিবী। শুধু ক্লিক করলে হাজির হচ্ছে আপনার চাওয়া যে কোনো ছবি, গান, কিংবা শিক্ষণীয় বিষয়। এক জাতি যে বিষয়কে সংস্কৃতি মনে করেন অন্যদের জন্য হয়তো তা নয়। ইউরোপীয় ও আমেরিকান সংস্কৃতিতে পর্নোগ্রাফি স্বাভাবিক হলেও বাংলাদেশের জন্য সেটি স্বাভাবিক নয়। অনলাইন পর্নোগ্রাফি বা সেলফোন পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরী, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যায়নরত ছাত্রছাত্রীদের কাছে এর চাহিদা ব্যাপক।
বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবসায়ে যে সাইটগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে অন্যতম নানা ধরনের পর্নোসাইট। পর্নো সাইটগুলো বন্ধে সরকার একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও তার বাস্তবায়ন আজও সম্ভব হয়নি। সমাজ বিজ্ঞানিরা বলছেন, বাংলাদেশের মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে বিজাতীয় আকাশ সংস্কৃতি। সন্ধ্যা হলেই বাংলার ঘরে ঘরে চালু হয়ে যায়, পারিবারিক ও সামাজিক সংঘাত ও নানা অপরাধ কণ্টকিত ভিনদেশী চ্যানেলগুলো। এসব চ্যানেলের সিরিয়ালগুলোর বিভিন্ন চরিত্র আমাদের ওপর প্রভাব ফেলে। এসব সিরিয়াল সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে আমাদের সংস্কৃতির। এসব সিরিয়ালে একাধিক প্রেম, পরকীয়া, যৌনতা, ঝগড়া-বিবাদ, খুনখারাবি। প্রভাব বিস্তার করছে আমাদের সমাজে। সবমিলিয়ে বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজ জীবনে বিরাজ করছে এক ধরনের অস্থিরতা- যার প্রতিফলন ঘটছে নানা ধরনের অপরাধের হার বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে।

No comments

Powered by Blogger.