কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেয় শিমুল

খুলনা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফুলতলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার আলাউদ্দীন মিঠু ও তার দেহরক্ষী নওশের আলী হত্যার মোটিভ উদঘাটনের দাবি করেছে পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডে অর্থ যোগানদাতা বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য লন্ডন প্রবাসী ড. মামুন রহমান ও ফুলতলা উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেনের অনুসারী শিমুল ভূঁইয়ার নেতৃত্বে কিলিং মিশনে অংশ নেয় সন্ত্রাসীরা। গ্রেপ্তারকৃত ফুলতলা উপজেলা বিএনপি সদস্য সচিব হাসনাত রিজভী মার্শালের আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
গতকাল দুপুরে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ এক প্রেস ব্রিফিংয়ে হাসনাত রিজভী মার্শাল ভূঁইয়ার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য লন্ডন প্রবাসী ড. মামুন রহমান হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে অর্থের যোগান দেন।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় ফুলতলা উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হাসনাত রিজভী মার্শাল খুলনার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কান্তি দালালের আদালতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। সোমবার সন্ধ্যায় র‌্যাব সদস্যরা খুলনা জিলা স্কুল এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। এ নিয়ে জোড়া হত্যা মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে শিমুল হাওলাদার এবং মুশফিকুর রহমান রিফাত ভূঁইয়া ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়। তবে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার তাজুল ইসলাম রনিকে রিমান্ডে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। 
প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিআইজি দিদার আহমেদ বলেন, হাসনাত রিজভী মার্শাল জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে, ড. মামুন রহমান এবং জেলা বিএনপির সাংগাঠনিক সম্পাদক সরদার আলাউদ্দীন মিঠু আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৫ (ফুলতলা-ডুমুরিয়া) আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিল। কিন্তু মিঠু থাকলে মামুন রহমান মনোনয়ন না পাওয়ার আশঙ্কা থেকেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে মোতাবেক মার্শালের মাধ্যমে তিনি ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। যা ২০ লাখ এবং ১০ লাখ করে দু’কিস্তিতে পরিশোধ করা হয়। আর মার্শাল চরমপন্থি সংগঠন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-জনযুদ্ধ) প্রধান শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে কিলার ভাড়া করে। চুক্তি অনুযায়ী মার্শাল ৩০ লাখ টাকা নিয়ে ২০ লাখ টাকা শিমুলেরর হাতে দেন। বাকি ১০ লাখ টাকা অন্যান্য কাজে খরচের জন্য রেখে দেন। ২৫শে মে শিমুলের নেতৃত্বেই মিঠু ও তার দেহরক্ষী নওশের গাজীকে হত্যা করা হয়। শিমুল ভূঁইয়া নিহত বিএনপি নেতা মিঠুর পিতা সরদার আবুল কাশেম হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সে ফুলতলা উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেনের অনুসারী হিসাবে পরিচিত। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগে কাশেম সরদার হত্যা মামলার অপর সাজাপ্রাপ্ত আসামি শিমুল ভূঁইয়ার ছোট ভাই শিবলু ভূঁইয়াকে আওয়ামী লীগে যোগদান করে দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান করা হয়।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রেঞ্জ ডিআইজি বলেন, পূর্ব শত্রুতা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পারিবারিক কারণেই চরমপন্থিদের দিয়ে মিঠুকে হত্যা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরো চারজনকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মিঠু নিহত হওয়ার পরে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আকরাম হোসেন সাংবাদিকদের কাছে প্রচার করেন শিমুল ভূঁইয়া দেশের বাহিরে রয়েছে। তার এ প্রচারণা প্রসঙ্গে ডিআইজির কাছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান কি করে জানলেন শিমুল ভূঁইয়া দেশের বাহিরে। মামলা তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজন হলে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ মামলায় যার বিরুদ্ধেই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যাবে- তাকেই গ্রেপ্তার করা হবে। তবে মামলার তদন্তের স্বার্থে সব তথ্য এ মুহূর্তে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রেসব্রিফিংয়ে র‌্যাব-৬ খুলনার পরিচালক খোন্দকার রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত ডিআইজি মো. হাবিবুর রহমান ও একরামুল হক, ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, মামুন রহমানের বিরুদ্ধে ডিআইজির করা অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। বিএনপির একজন নেতা আর একজনকে টাকা দিয়ে হত্যা করবে সে ধরনের প্রতিযোগিতা বিএনপির মধ্যে নেই। তিনি দাবি করেন, হত্যাকাণ্ডে অংশ গ্রহণকারীরা ফুলতলা আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালীর অনুসারী। তাকে রক্ষা করতে পুলিশ ভিন্ন তথ্য প্রচার করছে।
অপরদিকে নিহত বিএনপি নেতা সরদার আলাউদ্দিন মিঠুর ভাই সরদার সেলিম মিঠুর দেহরক্ষী শিমুল হাওলাদারের উদ্ধৃতি দিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, এক মাস আগে শিমুল এসে মিঠুকে জানায়, তাকে হত্যার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান আকরাম, ড. মামুন রহমান এবং মার্শাল বৈঠক করেছে। বৈঠকে মোট এক কোটি টাকা লেনদেনের কথা হয়। এর মধ্যে আকরাম ৫০ লাখ এবং মামুন রহমান ৫০ লাখ টাকা দেবে। কিন্তু মামুন রহমান ৫০ লাখের পরিবর্তে ৩০ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়। এ খবর জানার পর মিঠু সতর্ক চলাফেরা করতো। বাইরে সিকিউরিটি ছাড়া বের হতো না। বিষয়টি র‌্যাব এবং পুলিশকে জানানো হয় বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ২৫শে মে রাতে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে মিঠু ফুলতলার দামোদরে তার নিজ অফিসে বৈঠক করছিলেন বিএনপি নেতা মিঠু। এ সময় ডিবির জ্যাকেট পরে অস্ত্রধারীরা সেখানে প্রবেশ করে মিঠুর মাথায় গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ সময় মিঠুর দেহরক্ষী নওশের আলী অফিসের শাটার বন্ধ করার চেষ্টা করলে তাকেও গুলি করা হয়। তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেও মারা যায়।

No comments

Powered by Blogger.