দুর্বোধ্য আয়কর আইন থেকে মুক্তি মিলবে কবে?

'The hardest thing to understand in the world is the income tax'- এমন অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর যথার্থতা প্রমাণ করতে কাউকেই বেগ হতে হবে না। সৎভাবে জীবিকা নির্বাহ করে যারা আয়কর পরিশোধ করেন, তাদের অনেকেই হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। এ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে চান করদাতারা। আর রাজস্ব বোর্ডও সে কথা বলছে। কিন্তু বাস্তবতা তেমনটা নয়। দেশে সামরিক সরকারের আমলে তৈরি আয়কর অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ কর আদায় করা হয়। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কেউ এটি শুনলে নেতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদের দৃষ্টিতে, ‘বিদ্যমান আয়কর আইনটি জন্মগতভাবে ব্রিটিশ, প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ঔপনিবেশিক এবং পদ্ধতির দিক থেকে এখনও নিবর্তন ও প্রতিরোধাত্মক।’ জেমস উইলসনের হাত ধরে পাশ্চাত্য থেকে এই জনপদে এসেছিল আয়কর ব্যবস্থা। তিনি ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতের প্রথম বাজেট পেশ করেছিলেন। এর আগে ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে সিপাহি বিদ্রোহ দেখা দেয়। সে সময় অনেকটা ভড়কে গিয়েছিল ব্রিটিশ কর্মকর্তারা। কোনোভাবে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল শাসনব্যবস্থা। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনব্যবস্থা রদ হয়। কিন্তু ভারতের ভাগ্যবিধাতা হয়ে যান ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া।
১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয় ‘ভারত শাসন আইন’। রানীর হয়ে ভারতের শাসনভার দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় ভাইসরয়কে। ভাইসরয়কে পরামর্শ দেয়ার জন্য তৈরি হয় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল। তারই অর্থসংক্রান্ত বিষয় দেখাশোনা করতেন জেমস উইলসন। প্রথম বাজেটেই জেমস উইলসন এ দেশে আধুনিক আয়কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এর বড় কারণ ছিল সরকারের বাড়তি ব্যয় মেটাতে রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানো। এর আগে এ দেশে অন্য বিভিন্ন প্রকার কর বা খাজনা ধরনের রাজস্ব আয়ের ব্যবস্থা ছিল। প্রাচীন ভারতের মনুসংহিতা থেকে রাজস্ব আদায়ের সূত্র উল্লেখ করেছিলেন জেমস উইলসন। তবে তিনি ব্রিটেনের রাজস্ব আইনের কাঠামোয় আয়কর আরোপের রূপরেখা দেন। ১৯১৪-১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা লাগে ব্রিটিশ রাজে। তৈরি করা হয় ইনকাম ট্যাক্স অ্যাক্ট-১৯১৮। এই অ্যাক্টে মূলত তিনটি বিষয় উঠে আসে। এগুলো হচ্ছে- করযোগ্য আয়ের সামষ্টিক বিবেচনা, করবর্ষের ভিত্তি নির্ধারণ এবং করের আওতায় আনা হয় বিদেশি কোম্পানি। আর সেই পথ ধরে ‘ভারতীয় আয়কর আইন’ ১৯২২ সালে সংকলিত ও প্রবর্তিত হয়। সেই আইন ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ‘পাকিস্তান’ প্রতিস্থাপন করে চালু করে সরকার। ভারত ১৯৬১ সালে চল্লিশ বছরের পুরনো আয়কর আইনকে যুগোপযোগী করেছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলেও চৌদ্দ বছরের পুরনো আইন পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশে প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর ১৯৮৪ সালে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব আয়কর আইন প্রবর্তিত হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রথম আয়কর আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু করে রাজস্ব বোর্ড। ওই সময়ই ইংরেজিতে খসড়াটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে মতামত নেয়া হয়। কিন্তু সে সময় তেমন ইতিবাচক মতামত মেলেনি। এরপরে ২০১৩ সালে খসড়া তৈরি করা হয়। তা এখনও চলছে। ২০১৬ সালে এই আইন কার্যকরের কথা থাকলেও তা তৈরি করতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে এই আইন তৈরির উদ্যোগ। যে কারণে ভূমিজাত আইন আর পরামর্শমূলক আইনে এক ধরনের তফাৎ রয়ে যাবে।
এটা বেশ স্বাভাবিক। বাংলায় যে আইনের খসড়া তৈরি করা হচ্ছে, তাতে ভারতীয় আইনের অনেক প্রতিচ্ছাপ রয়েছে। অংশীজনদের মতামত পর্যালোচনা করে সমৃদ্ধ আইন তৈরি হোক, এ প্রত্যাশা অনেকদিনের। সরকার নতুন যে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, সেটিও তৈরি করা হয়েছে আইএমএফের পৃষ্ঠপোষকতায়। এটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে যাচ্ছে। এক বছর পিছিয়ে দিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাস্তবায়ন করা হবে। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন সংঘবদ্ধ শক্তি সরকারের সঙ্গে দেনদরবারে বেশ এগিয়ে থাকে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই নতুন আয়কর আইন চূড়ান্ত করা প্রয়োজন। আইন সহজ হলেই কি সাধারণের দুর্ভোগ কমবে? প্রায়োগিক প্রক্রিয়া ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সদিচ্ছাও দরকার। প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। তা না হলে সুফল মিলবে না। বর্তমান আইনে অনেক জটিলতা ও বৈষম্য রয়েছে। কর্মকর্তাদের ঐচ্ছিক ক্ষমতা দেয়ার ফলে হয়রানির শিকার হচ্ছেন করদাতারা। তাই নতুন আইনে যাতে ভোগান্তি কমানোর বিষয় প্রাধান্য পায়, সেদিকে খেয়াল রাখার তাগিদ দীর্ঘদিনের। নতুন আইনে কর আদায় ও নিরূপণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে ঘরে বসেই রিটার্ন জমা এবং কর পরিশোধের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। বিলুপ্ত হবে অডিটের বিধান; ফাঁকি রোধে থাকবে বিশেষ ব্যবস্থা। বর্তমান আইনে ২৯২টি ধারা রয়েছে। নতুন আইনে আরও ১৮ থেকে ২০টি ধারা যুক্ত হচ্ছে।
নতুন আইনটি বাংলা ভাষায় প্রণয়ন করা হবে। সহজ করে লেখা হবে যাতে সাধারণ করদাতারা বুঝতে পারেন। বিভিন্ন সময়ের আলোচনায় উঠে এসেছে, সব শ্রেণীর কোম্পানিকে অভিন্ন হারে কর দেয়ার বিধান রাখতে চায় রাজস্ব বোর্ড। বর্তমানে আটটি ক্যাটাগরির কোম্পানির কাছ থেকে ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কর্পোরেট কর আদায় করা হয়। নতুন এ ধরনের বিধান এক ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে। কোম্পানি করদাতার মোট সম্পদের ওপর পৃথক করারোপ করা হতে পারে। এ ছাড়া নিট সম্পদের ওপরও কর বসবে। উৎসে করের পরিধি কমানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সে অনুযায়ী পরিধি ৫৪টি খাতের পরিবর্তে ১৫টিতে সীমিত করা হবে। উৎস পর্যায়ে চূড়ান্ত কর আরোপের বিধানও উঠে যাবে। কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি না রাখা কিংবা সীমিত করার প্রস্তাবও করা হয়েছে খসড়ায়। খসড়ায় আরও প্রস্তাব করা হয়েছে, সমবায় সমিতি, অন্যান্য সমিতি, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের জন্য পৃথক করহার থাকবে। অর্থ পাচার ঠেকাতে জেল-জরিমানার বিধান রেখে নতুন আয়কর আইন করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন আয়কর আইনের খসড়ায় বেশকিছু নতুন ধারণা যোগ করা হয়েছে। মূল্য স্থানান্তর বা ট্রান্সফার প্রাইসিং প্রক্রিয়াকে আয়কর আইনের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আনা হবে। এ ছাড়া যে কোনো অর্থ স্থানান্তর বা পরিশোধকে আরও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায় আনার পাশাপাশি আইনি প্রক্রিয়া সুদৃঢ় করা হবে। এ ধরনের অর্থ পাচার নিরুৎসাহিত করতে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হবে নতুন আইনে। এখন খোঁজা হচ্ছে আয়ের নতুন নতুন উৎস। রাজস্ব আইনের বিশ্লেষকদের মতে, প্রচলিত অধ্যাদেশে আয়ের উৎস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়া হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশে ১৯৮৪ অনুযায়ী আয়ের খাত হচ্ছে নয়টি।
বেতনাদি, নিরাপত্তা জামানতের ওপর সুদ, গৃহ সম্পত্তির আয়, কৃষি আয়, ব্যবসা বা পেশার আয়। এ ছাড়া আছে, মূলধনী মুনাফা, অন্যান্য উৎস হতে আয়, ফার্মের আয়ের অংশ, স্বামী বা স্ত্রী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আয়। অধ্যাদেশের আওতার দুই ধরনের কর আরোপ করা হয়। তা হচ্ছে, ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট পর্যায়ে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে কর নৈতিকতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। বাংলাদেশ উচ্চমধ্য আয়ের পথে যাত্রা শুরু করেছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের যাত্রাপথে বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণ প্রবাহ কমতে থাকবে, যার প্রভাব আমরা দেখতে যাচ্ছি। স্বনির্ভর জাতি হিসেবে মর্যাদাশীল অবস্থান তৈরি করতে হলে প্রয়োজন বাড়তি বিনিয়োগ, দক্ষ জনবল। আর এসব উন্নয়ন এজেন্ডায় শরিক হতে প্রয়োজন নিজস্ব অর্থায়ন। অর্থাৎ রাজস্ব আহরণের মাত্রা বাড়িয়ে তোলা। সেটা হতে পারে করবান্ধব পরিবেশে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আয়করে নির্ভরশীলতা বাড়বে সরকারের। প্রত্যক্ষ করের ঝোঁক বাড়াতে হচ্ছে রাজস্ব বোর্ডের। কিন্তু আইএমএফের পছন্দমতো নতুন আইন দিয়ে নয়, অংশীজনদের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত করা হোক নতুন আইন ও বিধিমালা।
সাজ্জাদ আলম খান : সাংবাদিক
sirajgonjbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.