‘সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টান্তমূলক কাজের হাজারটা উদাহরণ দিতে পারি’

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করা সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানিতে গতকাল মতামত দিয়েছেন সিনিয়র আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি, এ জে মোহাম্মদ আলী ও ফিদা এম কামাল। এছাড়া গতকাল সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইন্টারভেনার হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চে গতকাল দশম কার্যদিবসে এর শুনানি হয়। দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে শুনানি শেষ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন আপিল বিভাগ। ১২ অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে গতকাল পর্যন্ত টি এইচ খান, আমীর-উল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এম আই ফারুকী, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, এএফএম হাসান আরিফ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী ও আজমালুল হোসেন  কিউসি (১০ জন) তাদের মতামত দিয়েছেন। এর আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেছিলেন। এছাড়া রিটকারী আইনজীবীদের পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদও শুনানিতে তার মতামত দিয়েছেন। 
গতকাল শুনানির একপর্যায়ে বিচার বিভাগের অবকাঠামোগত সমস্যার কথা অ্যামিকাস কিউরিদের কাছে আক্ষেপের সুরে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পাশাপাশি তিনি এও বলেন, সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টান্তমূলক কাজের হাজারটা উদাহরণ আমি দিতে পারি। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা করুণ অবস্থায় আছি। সরকার প্রাইমারি স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদে কম্পিউটার দেয়। কিন্তু আমার বিচারকদের একটা কম্পিউটারও দিতে পারে না! তিনি বলেন, বিচারকদের থাকার জায়গা নেই। এই সুপ্রিম কোর্টের একটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং নেই। সুপ্রিম কোর্টের অনেক অফিসারের বসার জায়গা নেই। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, এ ঘটনা সারা পৃথিবীতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলো। সারা দেশের মানুষ একটা ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা করলো। এই সুপ্রিম কোর্টের ইন্টারফেয়ারে এই মামলার  জট খুলে গেল। তিনি আরো বলেন, হাজারীবাগের ট্যানারির কথা বলতে পারি। সুপ্রিম কোর্টের ইন্টারফেয়ারেই ট্যানারি স্থানান্তরিত হলো। ঢাকা শহর দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেলো। ধানমন্ডি, গুলশান, বারিধারা লেকগুলো-  সুপ্রিম কোর্টের কারণেই রক্ষা পেলো। সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টান্তমূলক কাজের এমন হাজারটা উদাহরণ আমি দিতে পারি। এই সুপ্রিম কোর্টই দেশের জনগণের স্বার্থে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সব সময় পদক্ষেপ নিয়েছে। এই জুডিশিয়ারি রাষ্ট্রের প্রত্যেকটা মানুষের জন্য। গতকাল শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলো। কিন্তু এরপরের নির্বাচনে বা অন্য কোনো নির্বাচনে কোন দল সরকার গঠন করলেও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলো না। তখন একটি ঝুলন্ত সংসদ হলো। ওই সময় একজন বিচারকের বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে তখন কি হবে? তখন প্রধান বিচারপতি কি করবেন? কে আসবে তার কাছে? তিনি বলেন, ৪৫ বছর ধরে দেখছি। এখন এমন হয়েছে যে, একজন দাওয়াত দিলে আরেকজন যান না। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, কিভাবে হবে? একটি দল এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করে না।
গতকাল শুনানিতে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে তার মতামত তুলে ধরেন সিনিয়র আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। এই জনগণের ভোটে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিরাই জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। আর বিচারকরা জনগণের হয়ে বিচারকাজ করছেন। তাই তাদের জবাবদিহিতার প্রয়োজন আছে। এই জবাবদিহিতা করতে হবে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের কাছে। ফলে, ষোড়শ সংশোধনী ওই জায়গাতেই নিয়ে যাবে, যেখানে সংসদের কাছে জবাবদিহিতা থাকবে। শুনানিতে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর কারণে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। এটা থাকার কারণে ইচ্ছা থাকার পরও স্বাধীনভাবে নিজ দলের বিরুদ্ধে মতামত দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে কি জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে? তিনি আরো বলেন, বিচারক অপসারণের বিষয়েও সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারবেন না। ফলে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ফিদা এম কামাল বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোরই অংশ। সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে এটা বলা হয়েছে। এছাড়া এই সুপ্রিম কোর্টই রায় দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে রেখে দিয়েছে। এ ব্যবস্থাকে আদালত স্বচ্ছ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ অবস্থায় ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিল করতে পারে না।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। পরে ২২শে সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংবিধানের এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৫ই মে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। পরে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা ও মতামত দেয়ার জন্য গত ৮ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ১২ জন সিনিয়র আইনজীবীর (অ্যামিকাস কিউরি) নাম ঘোষণা করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.