আস্থা ও স্বার্থ রক্ষায় জোর দেওয়া উচিত

২০১০ সালের পর এই প্রথম শেখ হাসিনা দ্বিপক্ষীয় সফরে দিল্লি গেলেন। ২০১৪ সালের মে মাসে নরেন্দ্র মোদির অভিষেক অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত দেশের অনেক নেতা উপস্থিত থাকলেও শেখ হাসিনা যেতে পারেননি। কারণ, তখন তাঁর রাষ্ট্রীয় সফরে জাপানে যাওয়ার কথা ছিল। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ধারাবাহিক ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের ধারাটা সূচিত হয়েছিল ২০১০ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় প্রদত্ত যৌথ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। ওই ঘোষণায় অতীতের দ্বিপক্ষীয় উদ্বেগ কাটিয়ে উঠে দুই দেশ ভবিষ্যৎ অংশীদারির রূপরেখা ঘোষণা করে। পরের বছর তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় যে ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন স্বাক্ষরিত হয়, তার মাধ্যমেই সহযোগিতার সনদ প্রণীত হয়। তিস্তা নিয়ে জটিলতার মধ্যেই তা সম্পন্ন হয়। ২০১৫ সালে মোদির সফরের সময়ও এই চেতনা অক্ষুণ্ন ছিল, যার মাধ্যমে বহু প্রতীক্ষিত স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হয়। ওদিকে চীন ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ভারতের প্রান্তস্থ অঞ্চলে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে সক্রিয় হয়েছে। মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কায় তারা ধাক্কা খেয়েছে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে তারা নিজ লক্ষ্য পূরণে সওয়ার হবে। আবার চীনের ভারত সামলাও নীতিতে পাকিস্তান স্বেচ্ছায় যোগ দিচ্ছে। নেপাল দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে বোধগম্য সম্পর্ক বজায় রাখলেও সম্প্রতি কে পি ওলির সরকারের সময় তারা কিছুটা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
এরপর তাঁর উত্তরসূরি চীন সফর করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক স্থিতিশীল। তারা বাংলাদেশের প্রধান সমরাস্ত্র সরবরাহকারী। কিছুদিন আগে সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের সময় দেশ দুটির মধ্যে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বড় অঙ্কের ঋণ ও অনুদানও এর মধ্যে আছে। ঢাকা-বেইজিংয়ের সম্পর্ক ভারত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করলেও বাংলাদেশে চীনকে দেখলেই ভারতের প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত নয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে যে বাংলাদেশের মাটি থেকে যেন ভারতবিরোধী তৎপরতা পরিচালিত না হয়। এটা সহজ কাজ ছিল না। কারণ, সাবেক সরকার প্রশাসনের মধ্যে সে রকম মানুষ বসিয়ে গিয়েছিল, যাঁরা ভারতবিরোধী তৎপরতায় হাওয়া দিয়ে গেছেন। ভারত ও আওয়ামী লীগ উভয়ই জামায়াত ভাবাদর্শ প্রভাবিত ও পাকিস্তান সমর্থিত সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু ছিল। সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ সরকার অনেক চেষ্টারত থাকা অবস্থায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে পিছপা হয়নি। এই ব্যাপারে শেখ হাসিনা ভোটারদের দেওয়া কথা রেখেছেন। কিন্তু এর জন্য তাঁকে পশ্চিমাদের মারাত্মক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমনকি এ রকম হাস্যকর যুক্তিও দেওয়া হয়েছে যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কারণে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি এক প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক লিখেছেন, ‘যে গুলশানে সন্ত্রাসীরা ২০ জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিল, সেই গুলশানের রাস্তা থেকে বহু দূরে এই সন্ত্রাসবাদের হাতে গোনা কয়েকজন পৃষ্ঠপোষক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারে হাসিনার প্রচেষ্টার সুনামহানি করতে ব্রিটিশ ও মার্কিন লবিস্টদের কাজে লাগাচ্ছে।’ জামায়াত বাংলাদেশের সব সন্ত্রাসীর হোতা। তা সত্ত্বেও বিদেশে এদের লবিস্টরা প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে যাতে বাংলাদেশ একটি উদার, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্থিতিশীল না হয়। এর মধ্যে মার্কিন সরকারের একটি অংশও ছিল, যারা পাকিস্তানি বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
জন কেরির সময় এটা হয়েছে। এখন ট্রাম্পের জমানায় অবস্থা বদলায় কি না, তা-ই দেখতে হবে। ব্যাপারটা হচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে সম্প্রতি পরিপক্বতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ, এই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আমাদের অনেক কিছু করতে হবে। কিন্তু বর্তমানকে আমাদের অতীতের পাটাতনে দেখতে হবে। এই এক দশক আগেই এই সহযোগিতামূলক সম্পর্কের কাঠামোটা অসম্ভব মনে হতো। তারপর তো দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা সমুদ্রসীমার সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক আদালত বাংলাদেশের পক্ষে যে রায় দিয়েছেন, ভারত সেটাকে মর্যাদা দিয়ে মেনে নিয়েছে। স্থলসীমান্ত চুক্তির অবস্থাও একই রকম ছিল, আমরা এখন সেটিও পার করে এসেছি। খুব বেশি মানুষ খেয়াল না করলেও ছিটমহলে কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের স্থানান্তর হয়নি। মানুষ ভিন্ন জাতীয়তা নিয়ে নিজের ভূমিতেই থেকে যায়। অন্যদিকে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। তেমনি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিমাণও বেড়েছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ আসছে তা দেশটির অনেক মানুষের জীবনেই পরিবর্তন বয়ে আনছে। সর্বোপরি, বাংলাদেশ এখন আর ভারতবিরোধী শক্তির আশ্রয়স্থল নয়। তবে ভারতের পক্ষে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করার অক্ষমতাই এই সম্পর্কের মধ্যে একমাত্র ফাঁক। চুক্তি ছাড়াও আলোচনায় বাংলাদেশের যে পরিমাণ পানি পাওয়ার কথা, সেটা সে পেতে পারে। ব্যাপারটা যেমন পানির পরিমাণের, তেমনি বাংলাদেশের পানি পাওয়ার অধিকারের। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পূর্বসূরি জ্যোতি বসুর কথা স্মরণ করতে পারেন। দুই দশক আগে ফারাক্কা চুক্তি করার ক্ষেত্রে তিনি একক ভূমিকা পালন করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। সম্প্রতি এক বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ঢাকায় ভারতীয় গোয়েন্দারা মার্কিন দূতাবাসে বসে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে আওয়ামী লীগকে হারানোর ফন্দি করেছেন। এটার সত্যাসত্য নিয়ে মাথা না ঘামিয়েই বলা যায়, বন্ধুপ্রতিম দেশের সরকারপ্রধানের এই অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এটা যদি সত্য হয় তাহলে ব্যাপারটা দুঃখজনক, বিশেষত বিএনপি সরকারের মারাত্মক ভারত বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারত, যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ভারত বিভিন্ন দেশে গিয়ে দেনদরবার করে এটা নিশ্চিত করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে নির্বাচন যেন বাতিল না হয়। শেখ হাসিনা ভারতের বন্ধু। তিনি দ্ব্যর্থহীন দৃঢ়তার সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তা সমস্যা আমলে নিয়েছেন। হাসিনা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপ ধর্তব্যে নিয়েও ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক লালন করেছেন। তাই এই চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পারস্পরিক আস্থা ও স্বার্থ রক্ষায় জোর দেওয়া উচিত।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
দেব মুখার্জি: বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার।

No comments

Powered by Blogger.