কালের সাক্ষী লালবাগ কেল্লা

বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লালবাগ কেল্লা। রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গার কোলঘেঁষে কালের সাক্ষী হয়ে থাকা এ ঐতিহাসিক নিদর্শনটি দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান। এখানকার পুরাকীর্তির মাধ্যমে যেমন কয়েকশ’ বছর আগের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়, তেমনি এর বাহ্যিক সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করতে পারে। তাই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এটি পরিদর্শনের জন্য প্রতি বছর কয়েক সহস্রাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। তাছাড়া রাজধানীর বাসিন্দাদের কাছে লালবাগ কেল্লা হচ্ছে রোমাঞ্চকর বিনোদন কেন্দ্র। জানা যায়, ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম সম্রাট আওরঙ্গজেবের সুযোগ্য পুত্র শাহজাদা আজম এ প্রাসাদ নির্মাণ কাজের সূচনা করেন। পরে সুবেদার শায়েস্তা খানের শাসনামলে ১৬৮৪ সালে নির্মাণকাজ অসমাপ্ত রেখে দুর্গটি পরিত্যক্ত হলে এর স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর অভ্যন্তরে স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে হাম্মামখানাসহ একটি সুরম্য দ্বিতল দরবার হল, একটি সমাধি সৌধ, তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ ও একটি পুকুর। যদিও কয়েক বছর ধরে পুকুরটিতে পানি নেই। তাছাড়া তিনটি সুদৃশ্য তোরণের পাশাপাশি দক্ষিণ এবং পশ্চিমের দুর্গ প্রাচীরের নির্দিষ্ট দূরত্বে পরপর একটি করে তোপমঞ্চ রয়েছে। ১৭০০ শতাব্দীর এসব স্থাপনাশৈলী দেখলে প্রাচীন মুঘল শাসনামলের খণ্ডচিত্র যে কারোর চোখের সামনে ভেসে আসে। বিশেষ করে হাম্মাম ও দরবার হলে সুবেদার শায়েস্তা খানের ব্যবহারের জন্য সুরম্য দ্বিতল ভবনটিতে সংরক্ষিত থাকা পারকাশন লক পিস্তল, ফ্রিন্ট লক পিস্তল, সিসার গুলি, কামান, লোহার তরবারি, সুরাহি ধাতু দিয়ে তৈরি চীনা গামলা ও সঞ্চয়পত্র, সৈনিক পোশাক, লোহার জালের বর্ম, গুপ্তি, তীর ও বর্ষা, বক্ষবর্ম নিরোধকসহ এর অসংখ্য নিদর্শনই বলে দেয় তৎকালীন শাসনব্যবস্থার ধরন কী ছিল। অবশ্য কয়েকশ’ বছর এসব নিদর্শন ভবনটির দ্বিতীয় তলায় সংরক্ষিত থাকলেও সেখানের কক্ষগুলো পরিত্যক্ত হওয়ায় বর্তমানে নিচতলার কক্ষগুলোতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লালবাগ কেল্লার অন্যতম আকর্ষণ হল, এর ভেতরে পশ্চিম পাশে অবস্থিত শায়েস্তা খানের প্রিয় কন্যা পরীবিবির সমাধি। ১৬৮৮ সালের আগে নির্মিত ২০.২ মিটার আয়তনের এ সমাধি সৌধটি মার্বেলপাথর, কষ্টিপাথর ও বিভিন্ন রঙের ফুলপাতা সুশোভিত, চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ ৯টি কক্ষ অলঙ্কৃত হয়েছে। কক্ষগুলোর ছাদও কষ্টিপাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মূল সমাধি সৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের ওপরের কৃত্রিম গম্বুজটি তামার পাত দিয়ে তৈরি হওয়ায় এতে যোগ হয়েছে ভিন্ন মাত্রা। বাংলাদেশে এমন সমাধি সৌধ দ্বিতীয়টি নেই। তাছাড়া দরবার হলের বাঁকানো ছাদটিতে বাংলাদেশের গ্রামীণ ঐতিহ্য চিত্রায়িত হয়েছে। এর পাশাপাশি দক্ষিণ পাশে থাকা শায়েস্তা খানের একান্ত বিশ্বস্ত সহসেনা অধিনায়ক খোদাবন্ধ মির্জা বাঙালির সমাধির উভয় পাশে অজ্ঞাত দুই শিশুর কবরও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। এসব স্থাপনার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় নিদর্শন হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত রাজকীয় তোরণ। তিন তলাবিশিষ্ট এ তোরণটির শীর্ষের দুদিকে দুটি চিকন সুশোভিত মিনার ছাড়াও রয়েছে আট কোনাকার একটি টারেট। ভেতরে দু’পাশে দুটি সিঁড়িপথের উভয় দিকে প্রবেশের জন্য রয়েছে আলাদা বড় আকারের খিলান দরজা। এর ছাদের নিচের গম্বুজ আকৃতির সিঁড়িপথগুলোতে দর্শনার্থীরা কাটিয়ে থাকেন অবকাশ সময়। আর দুই পাশে রয়েছে ছোট ছোট প্রহরী কক্ষ। তবে একসময় চূড়ার চার কোনায় চারটি মিনারের ওপর ছোট আকৃতির গম্বুজ থাকলেও বর্তমানে মাত্র দুটির অস্তিত্ব আছে।
এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন ছাড়াও সম্প্রতি লালবাগ কেল্লাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর প্রতিষ্ঠিত লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। ২০১৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে ডিজিটাল ডিসপ্লেতে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পগুলোর ছবি। অবশ্য এটি উপভোগ করতে হলে দর্শনার্থীদের গুনতে হবে অতিরিক্ত ২০ টাকা। এর জন্য সময়ও নির্ধারিত রয়েছে আলাদা। কারণ রোববার সাপ্তাহিক বন্ধ ছাড়া লালবাগ কেল্লা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। আর সোমবার থাকে অর্ধদিবস বেলা দেড়টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। প্রবেশের জন্য টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে দেশি পর্যটক ২০, সার্কভুক্ত দেশ ১০০, অন্য বিদেশি পর্যটক ২০০ এবং মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ৫ টাকা। লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো প্রদর্শিত হয় সন্ধ্যা ৬টা ১০ থেকে পরবর্তী ৩০ মিনিট। তাই কেল্লার দর্শনার্থীরা সেখান থেকে বের হওয়ার পরই নতুন টিকিটে তা দর্শন করতে পারেন। তবে একটি আফসোস নিয়ে সেখান থেকে বের হতে হচ্ছে দর্শনার্থীদের। তা হল- এর ভেতরে চারদিকে সীমানাবেষ্টিত একমাত্র পুকুরে পানি না থাকা, ফোয়ারাগুলো নষ্ট হওয়ায় ছয়-সাত বছর ধরে পানিবিহীন লেক এবং মাটির নিচের পর্যটন টাওয়ারটি অকার্যকর থাকা। এসব আকর্ষণীয় জিনিস বন্ধ থাকায় আনন্দ ষোলোকলা পূর্ণ করতে পারছে না মানুষ। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দ্বৈত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ থাকা এবং দর্শনার্থী অনুপাতে বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগার ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ায় এ স্থাপনাটির সুনাম কিছুটা ম্লান হতে পারে বলে মনে করেন অনেক দর্শনার্থী। দর্শনার্থী জিয়াউল হাসান খানের মতে, ছোটখাটো সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান না করলে এর নিজস্ব সুনাম ধরে রাখা কঠিন হবে। নারী দর্শনার্থী সাহিদা মনে করেন, দু-একটি সমস্যা বাদ দিলে লালবাগ কেল্লা হচ্ছে আমাদের গৌরবে অমলিন এক অনন্য নিদর্শন। একই কথা বললেন লালবাগ দুর্গ জাদুঘরের কস্টোডিয়ান হালিমা আফরোজ। তিনি বলেন, এ দুর্গটি হচ্ছে বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য শিল্প। এর কিছু সমস্যা বিশেষ করে লেকগুলো কয়েক বছর ধরে অকার্যকর থাকায় পর্যটকরা পরিপূর্ণ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপের কারণে ইতিমধ্যে তা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আগা খান ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান এর দায়িত্ব পেয়েছে বলে তিনি জানান। শিগগিরই এ সমস্যাসহ অন্য সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.