পাবনার হাটবাজারে পচাঁ পেঁয়াজের ঝাঁঝাঁলো গন্ধ

পাবনা জেলায় এবার পেঁয়াজের আশাতীত ফলন হয়েছে। জমি থেকে পেঁয়াজ ও পেঁয়াজবীজ সংগ্রহ চলছে পুরোদমে। কৃষাণ-কৃষাণীদের দম ফেলার সময় নেই। তারা পেঁয়াজের ডাটাকাঁটা ও বাছাইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। হাট-বাজারে প্রচুর নতুন পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। প্রতিমণ পেঁয়াজ মানভেদে ৭০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা দরে বিক্রি করে চাষিরা খুশি। আবার পেঁয়াজ হাটে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র, চাষিরা শিলাবৃষ্টিতে আধাপঁচা পেঁয়াজ প্রতিমণ বিক্রি করছেন ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা দরে। এই পেঁয়াজের ক্রেতা সাধারনত স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ীরা। অনেক চাষি পেঁয়াজ বিক্রি করতে না পেরে আধাপঁচা পেঁয়াজ হাটেই ফেলে দিয়ে যাচ্ছেন। এমন দৃশ্য দেখা গেছে, পাবনার বেড়া, কাশিনাথপুর, বোয়ালমারি, বনগ্রাম, আতাইকুলাসহ অন্যান্য হাটে। এদিকে পঁচা পেঁয়াজের ঝাঁঝাঁলো গন্ধে হাটবাজারে আশপাশের এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পাবনা কৃষি সম্প্রসারন অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলায় গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রায় ১১ হাজার ২০৪ হেক্টর জমিতে বেশি পেঁয়াজ আবাদ হয়েছিল। পাবনার সুজানগর উপজেলায় ১৮ হাজার হেক্টরে দুই লাখ ৪৩ হাজার টন, সাঁথিয়ায় ১৬ হাজার হেক্টরে দুই লাখ ১৬ হাজার টন, পাবনা সদরে পাঁচ হাজার হেক্টরে ৬৭ হাজার ৫০০ টন, ঈশ্বরদীতে দুই হাজার ২১০ হেক্টরে ২৯ হাজার ৮৩৫ টন, বেড়ায় দুই হাজার হেক্টরে ২৭ হাজার টন, ফরিদপুরে এক হাজার ১০০ হেক্টরে সাড়ে ১৪ হাজার ৮৫০ টন, চাটমোহরে এক হাজার ১০০ হেক্টরে সাড়ে ১৪ হাজার ৮৫০ টন, ভাঙ্গুড়ায় এক হ্াজার হেক্টরে ১৩ হাজার ৫০০ টন ও আটঘড়িয়ায় এক হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সাড়ে ২০ হাজার ২৫০ টন পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছিল। প্রায় ৪৭ হাজার ৯২২ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রতি হেক্টরে গড়ে সাড়ে ১৩ টন হিসেবে প্রায় ছয় লাখ ৪৬ হাজার ৯৪৭ টন।
তবে আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় এবছর পেঁয়াজ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি হেক্টরে গড়ে ১৪ টন হিসেবে পেঁয়াজ উপাদন হয়েছে ৬ লাখ ৭১ হাজার টন। তবে প্রাকৃতিক দূর্যোগে বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় প্রায় ৩৪ হাজার টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। জানা যায়, সম্প্রতি সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় হালকা বৃষ্টির সাথে ভারি শিলাপাতে জমির পেঁয়াজ, পেঁয়াজবীজ, রসুন, আলু, কাউন, শসা, বাদাম, সাজনা, গম, জব, মরিচ, পটল, বেগুন, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, বাঙ্গি, তরমুজ, করলা, লাউসহ বিভিন্ন উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ২০ মিনিট স্থায়ী ভারি শিলাপাতে দু’টি উপজেলায় ৪ হাজার ১০২ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল প্রায় সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে। এরমধ্যে সাঁথিয়া উপজেলায় ২ হাজার হেক্টর জমির পেঁয়াজ, ১০৬ হেক্টরের পেঁয়াজবীজ, ৯৬ হেক্টরের রসুন, ২৭০ হেক্টরের গমসহ অন্যান্য ফসল ১৫৫ হেক্টর, বেড়া উপজেলায় ৫০০ হেক্টর জমির পেঁয়াজ, ২৬ হেক্টরের পেঁয়াজবীজ, ৫০ হেক্টরের রসুন, ৪০০ হেক্টরের গম এবং ৫০০ হেক্টরের অন্যান্য ফসল বিনষ্ট হয়েছে। ভারতীয় পেঁয়াজের কারণে এ অঞ্চলের কৃষকদের মুলকাটা পেঁয়াজে ব্যাপক লোকসান দিতে হয়েছে। শিলাবৃষ্টিতে পেঁয়াজ, পেঁয়াজবীজ, রসুনসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি তাদের মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বিলমহিষারচর, কোনাবাড়ী, শরিষা, ভিটাপাড়া,, হাড়িয়া, ডহরজানি, বিলসলঙ্গি, হাড়িয়াকাহন, চরপাকুরিয়া, গৌরিগ্রাম, সাতানিরচর, পুরানচর, গোপিনাথপুর, পুন্ডুরিয়া, সৈয়দপুর, কালাইচড়া, বাউসগাড়ী, পাথাইলহাট, নাগডেমরা, সেলন্দা, মনমথপুর, ছেঁচানিয়া, সোনাতলা, ধুলাউড়ি, বায়া, করমজা, কড়িয়াল বেড়া উপজেলার হাতিগাড়া, বরশিলা, চাকলা, দমদমা, পায়না, হাটুরিয়া, পেঁচাকোলা, চরপেঁচাকোলা, চরনাগদা, কৈটোলা, রাকশা, বাটিয়াখড়া, বকচর, সোনাপদ্মা, মাসুমদিয়া গ্রাম সরেজমিন ঘুরে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বেড়া ও সাঁথিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল পেঁয়াজ। সাম্প্রতিক শিলাবৃষ্টিতে ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির প্রায় ৩৪ হাজার টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। এই পেঁয়াজ প্রতিমণ ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
অনেকে ক্রেতা অভাবে পেঁয়াজ বিক্রি করতে না পেরে হাটেই ফেলে দিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় ১৩২ হেক্টর জমির পেঁয়াজবীজ মাটির সাথে মিশে গেছে। রসুনের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২ হাজার টন। আধাপঁচা পেঁয়াজ ও রসুনের ক্রেতা সাধারনত স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ী। তারা ভাল পেঁয়াজ ও রসুনের সাথে আধাপঁচা পেঁয়াজ রসুন মিশিয়ে বিক্রি করছেন। পাবনার প্রধান প্রধান হাট-বাজারে পঁচা পেঁয়াজের ঝাঁঝাঁলো গন্ধে আশপাশের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বেড়া উপজেলার খাকছাড়া গ্রামের কৃষক আজাহার প্রামানিক জানান, সে এবার ৩ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছিলেন। বাম্পার ফলেনের আশায় দিন গুনছিলেন। কিন্তু তার শ্রমে-ঘামে ফলানো কষ্টের ফসল পেঁয়াজ ঘরে তুলতে পারেননি। গত ১৭ মার্চ বিকেলে মাত্র ২০ মিনিটের শিলাবৃষ্টিতে তার ক্ষেতের ফসল লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সেই সাথে ভেঙে যায় তার সব আশা স্বপ্ন। এখন ক্ষেতের পেঁয়াজ পঁচে গেছে। এখন কিভাবে মাহাজনের ঋণশোধ করবেন এ চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এমন ক্ষতির শিকার হয়েছেন সাঁথিয়া বেড়া অঞ্চলের শত শত পেঁয়াজ চাষি। বেড়া সিঅ্যান্ডবি চতুরহাটে পেঁয়াজ বিক্রি করতে আসা সাঁথিয়া উপজেলার কৃষক পুলক বলেন, তিনি এবার ১০ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছিলেন। আশা করেছিলেন ৫০০ মণের বেশি পেঁয়াজ পাবেন। জমিতে পেঁয়াজ তুলতে গিয়ে দেখেন প্রায় সব পেঁয়াজ পঁচে গেছে। মাত্র ৪০ মণ আধাপঁচা পেঁয়াজ পেয়েছেন। চতুরহাটে ৫০ টাকা দরে ৪ মণ পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন। অবশিষ্ট পেঁয়াজ বিক্রি করতে না পেরে হাটের পাশে খালে ফেলে দিয়েছেন। শালঘর ভবানীপুর গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক জানান, সে এবার আড়াই বিঘা জমিতে পেঁয়াজবীজ আবাদ করেছিল। আবাদে তার খরচ হয়েছে প্রায় পৌণে ৩ লাখ টাকা। নজিরবিহীন শিলাপাতে তার ক্ষেতের পেঁয়াজবীজ (কদম) মাটির সাথে মিশে গেছে। এ ফসল থেকে একটি টাকাও পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবাদের পুরো টাকাই লোকসান হয়েছে। এমন দূরাবস্থা শুধু মাহাতাব ও রাজ্জাকের নয়, সাঁথিয়া উপজেলার প্রায় প্রতিটি কৃষকই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ উপজেলায় চলতি মওসুমে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় এক লাখ ৭৬ হাজার টন। কৃষি বিভাগ ও কৃষকেরা বাম্পার ফলনের আশা করেছিলেন। সাম্প্রতিক শিলাবৃষ্টিতে বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় প্রায় ৩৪ হাজার টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, পাবনা জেলায় অন্যান্য বছরের চেয়ে এবছর বেশি জমিতে পেঁয়াজবীজ চাষ হয়েছিল।
সুজানগর ও সাঁথিয়া উপজেলায় সবচেয়ে বেশি জমিতে পেঁয়াজ ও বীজের আবাদ হয়ে থাকে। পাবনা সাঁথিয়া, সুজানগর ও চাটমোহর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় হাজার কৃষক পেঁয়াজবীজ চাষ করেছিলেন। এখানে তিন জাতের বীজ চাষ হয়। তাহেরপুরী, ফরিদপুরি ও মিটকা। তবে তাহেরপুরী জাতের চাষ বেশি হয়। প্রাকৃতিক দূর্যোগে সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার প্রায় ৮০ ভাগ পেঁয়াজবীজ নষ্ট হয়ে গেছে। চাষি ক্ষেত থেকে পুরোদমে পেঁয়াজবীজ পেঁয়াজ সংগ্রহ করছেন। প্রতি একরে গড় ফলন হবে ৮ থেকে ৯ মণ বীজ বলে আশা করছেন কৃষকেরা। বাজার দর স্বাভাবিক থাকলে প্রতি মণ বীজ বিক্রি হবে এক লাখ টাকা। এসব পেঁয়াজবীজ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মহাজন ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে কেজি দরে কিনে নিয়ে যান। এসব বীজ উচ্চমূল্যে ভারতে পাচার হয়। গত বছর বীজের কেজি ছিল দুই হাজার ৫০০ টাকা। এলাকাভিত্তিক এ দাম আরো বেড়ে যায়। এ এলাকার উৎপাদিত বীজের চাহিদা দেশের সর্বত্র। সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামের পেঁয়াজবীজ চাষি আনোয়ার হোসেন জানান, গত বছর ৬০ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজবীজ চাষ করে পাঁচ মণ বীজ পেয়েছিলেন। প্রতি কেজি বীজ দুই হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করেছিলেন। এবছর তিনি এক একর জমিতে পেঁয়াজবীজ আবাদ করেছিলেন। শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে তার এক একর জমির বীজই নষ্ট হয়ে গেছে। সুজানগর উপজেলার বিলগাজনা গ্রামের পেঁয়াজবীজ চাষি সন্তোষ মন্ডল ও রফিক মোল্লা জানান, পেঁয়াজের দানা উৎপাদন অতি লাভজনক হলেও ঝুঁকিও রয়েছে। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে প্রাকৃতিক দূর্যোগ না হলে একজন কৃষক এক মওসুমেই ধনী হতে পারেন।
প্রতি একর জমিতে বীজ উৎপাদন করতে এক লাখ ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ পড়ে। পেঁয়াজ দানা উৎপাদন করতে অর্থের প্রয়োজন হয়, যা প্রান্তিক বা গরিব চাষিদের পক্ষে যোগান দেয়া সম্ভব নয়। বেড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ ইসমাইল হোসেন বলেন, পেঁয়াজের দানা বীজ উৎপাদনে কৃষকদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছে কৃষি বিভাগ। লাভজনক হওয়ায় দিনদিন এ চাষ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে। পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ (খামারবাড়ি) অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভূতি ভূষণ সরকার এ প্রতিবেদককে জানান, এবার পিঁয়াজ বীজের মান ভাল ছিল। চলতি বছর পাবনা জেলায় ২৫ হাজার কৃষক ফরিদপুরি, তাহেরপুরী ও মিটকা জাতের পেঁয়াজ আবাদ করেছেন। তবে তাহেরপুরী জাতের আবাদ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। প্রায় ৪৭ হাজার ৯২২ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রতি হেক্টরে গড়ে সাড়ে ১৩ টন হিসেবে প্রায় ছয় লাখ ৪৬ হাজার ৯৪৭ টন। আবহাওয়া অনুকুুলে থাকায় পেঁয়াজ উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ১৪ টন। তবে সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় সাম্প্রতিক শিলাবৃষ্টিতে অন্যান্য ফসলের সাথে পেঁয়াজ ও পেঁয়াজবীজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.