জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট হচ্ছে ৩০-৪০টি ইসলামী দলের

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ৩০ থেকে ৪০টি রাজনৈতিক দল আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আশা করছি এ মাসের মধ্যেই নতুন জোটের ঘোষণা দিতে পারব। তিনি বলেন, আমরা শক্তি সঞ্চয় করছি, দেখাতে চাচ্ছি জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমাদের শক্তি আছে। দেশ চালানোর যোগ্যতা আমার আছে। সোমবার নরসিংদী জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন তিনি। নরসিংদী পৌর ঈদগাহ ময়দানে আয়োজিত সম্মেলনে দেশবাসীর উদ্দেশে এরশাদ বলেন, হয়তো এটিই আমার শেষ নির্বাচন। আমাকে আরেকবার সুযোগ দিন। ক্ষমতায় গেলে আমি একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলব। আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়ার ঘোষণা দেন এই নেতা। তিনি বলেন, দেশে আজ সুখ, শান্তি, সুশাসন ও নিরাপত্তার অভাব। প্রতিদিন মানুষ মরছে। প্রতিদিন লাশ পড়ছে। অতীতে কখনও এত লাশ পড়েনি। একের পর এক মায়ের বুক খালি হচ্ছে। ক’জনইবা এই খবর রাখছি। আমাদের শাসনামলে দেশে সুখ-শান্তি ও সুশাসন ছিল। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় গেলে সুশাসন ও মানুষের নিরাপত্তা ফিরে আসবে। তিনি বলেন, আমি অনেক বছর ক্ষমতায় নেই। তার পরও এই দেশের মানুষ আমাকে অনেক ভালোবাসে। এই জনসমাবেশই তার প্রমাণ। তিনি বলেন, দেশে আজ রাজনীতি নেই। একটি দল অফিসে বসে বক্তব্য রাখছে। বাইরে তাদের কোনো কর্মকাণ্ড নেই। একমাত্র জাতীয় পার্টি দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে দলকে শক্তিশালী করতে। আমার বিশ্বাস জনগণকে সংগঠিত করতে পারলে আগামী দিনে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসবে।
তিনি বলেন, আমাদের কোনো বন্ধু নেই। আমাদের বন্ধু আপনারা, জনগণ-কৃষকরা। জনগণ পাশে থাকলে খুন-গুমের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করব। তিনি বলেন, ’৯০ সালে গণতন্ত্র রক্ষায় স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলাম। বিশ্বাস ছিল আমি নির্বাচন করতে পারলে আবার ক্ষমতায় আসব। কিন্তু আমাকে নির্বাচন করতে না দিয়ে জেলে পাঠানো হল, আমি ছয় বছর জেলে ছিলাম। কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। তারা চেয়েছিল আমাকে জেলখানায় হত্যা করতে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি বেঁচে আছি। যারা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল তারাই আজ হারিয়ে গেছে। এরশাদ বলেন, ’৯৬ সালে বিএনপি আমার কাছে সমর্থন চেয়েছিল। আমাকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছি। আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছি। আমার সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগ আমার প্রতিও সুবিচার করেনি। তিনি বলেন, ২৫-৩০ বছর ধরে আমার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা ঝুলছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি যারাই যখন ক্ষমতায় এসেছে তারা তাদের দলীয় লোকজনের অসংখ্য মামলা প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু আমার একটিও মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। আমার প্রতি কেউ সুবিচার করেনি। এরশাদ বলেন, মানুষ পরিবর্তন চায়, তারা জাতীয় পার্টিকে আবার ক্ষমতায় দেখতে চায়। একটি কথা মনে রাখতে হবে, দুর্বলের সঙ্গে কেউ হাত মেলায় না। জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হলে আগামীতে অবশ্যই ক্ষমতায় যাবে। তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমার হাতকে শক্তিশালী করুন।
আমরা ক্ষমতায় যাব। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় গেলে মানুষ সুখে-শান্তিতে থাকবে। এ সময় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় পার্টির মহাসচিব সাবেক মন্ত্রী এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, গ্রামগঞ্জে একটা আওয়াজ উঠেছে, তারা জাতীয় পার্টিকে আবার ক্ষমতায় দেখতে চায়। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এই দেশের সব উন্নয়নের উদ্যোক্তা। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় মহিলা পার্টির সভানেত্রী ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যত উন্নয়ন হয়েছে, তা একমাত্র এরশাদ সরকারের আমলেই হয়েছে। তিনি বলেন, এই নরসিংদী জেলা আগে মহকুমা ছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নরসিংদীকে জেলায় রূপান্তরিত করেছিলেন। নরসিংদীর প্রশাসনিক ভবন, এলজিইডি ভবন, নতুন নতুন রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট সব জাতীয় পার্টির আমলেই হয়েছে। অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা পদ্ধতির মাধ্যমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঘুমন্ত গ্রামগুলোকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। ঠিক তেমনিভাবে আজকের এই সমাবেশের মাধ্যমে জাতীয় পার্টিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আর তা হলেই জাতীয় পার্টির জন্য ক্ষমতায় যাওয়া সহজ হবে।’ তিনি বলেন, ‘আজ আমরা এমন একটি সময়ে মিলিত হয়েছি, যখন সারা দেশের মানুষ দিশেহারা। আওয়ামী লীগ চায় ক্ষমতাকে কিভাবে পাকাপোক্ত করা যায়, আর বিএনপি চায় কিভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায়। এই দুই দলের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে দেশের সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এ জন্য দরকার জাতীয় পার্টির সরকার’। অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, বাংলার আনাচে-কানাচে এরশাদের উন্নয়নের ছোঁয়া লেগে আছে। মানুষ আজ বুঝতে পারছে দেশের উন্নয়নের জন্য এরশাদের বিকল্প নেই।
এরশাদ উপলব্ধি করেছিলেন, গ্রামবাংলার উন্নয়ন করলে দেশ এগিয়ে যাবে। এজন্য তিনি বলেছিলেন, ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রতিটি উপজেলায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট চালু করেছিলেন। এতে গ্রামের সাধারণ মানুষের উপকার হয়েছিল। তিনি বলেন, মানুষের জীবনে আজ নিরাপত্তা নেই। গুম, খুন আর দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ। যুবসমাজের কর্মসংস্থান নেই। দমবন্ধ পরিবেশ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। এজন্য জাতীয় পার্টিকে সংগঠিত করতে হবে। এরশাদের শাসনামলের সুন্দর দিনগুলোর কথা দেশবাসীর কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে। অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, ‘আমরা জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখছি। সংসদ বর্জন না করে জনগণের সব দাবি মহান জাতীয় সংসদে তুলে ধরছি। আমাদের প্রাণপ্রিয় চেয়ারম্যান পার্টিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন জেলায় সম্মেলন করছেন। আমাদের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল। আজকের এই দিনে আসুন সব ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় পার্টিকে সু-সংগঠিত এবং শক্তিশালী করে গড়ে তুলি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি সবাই মিলে চেষ্টা করি তাহলে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে পারব ইনশাআল্লাহ্।’
সম্মেলন ঘিরে নরসিংদী শহরকে বর্ণাঢ্য সাজে সাজানো হয়। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা থেকে সম্মেলনস্থল পর্যন্ত প্রায় ৪০টি তোরণ নির্মাণ করা হয়। শহরজুড়ে লাগানো হয় ব্যানার-ফেস্টুন। দুপুর ১টার দিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারসহ কেন্দ্রীয় নেতারা নরসিংদীতে আসেন। স্থানীয় নেতাকর্মীরা শতাধিক মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে পাঁচদোনা থেকে তাদের বরণ করেন। সম্মেলন উপলক্ষে নেতাকর্মীদের মাঝে নেমে এসেছে উৎসাহের আমেজ। শহর ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী মিছিল নিয়ে সম্মেলনে যোগ দেন। বিকাল গড়াতেই সম্মেলনস্থল নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। অনেকের হাতে নানা রঙের ব্যানার, ফেস্টুন, দলীয় পতাকা, দলীয় প্রতীক লাঙ্গল শোভা পায়। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও নরসিংদী জেলার সভাপতি শফিকুল ইসলাম শফিকের সভাপতিত্বে সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফয়সল চিশতী, আলমগীর শিকদার লোটন, সাংগঠনিক সম্পাদক আমির হোসেন ভুঁইয়া এমপি, কেন্দ্রীয় নেতা আবু সাঈদ স্বপন, ইঞ্জিনিয়ার এমএ সাত্তার, জাতীয় মহিলা পার্টির সাধারণ সম্পাদক অনন্যা হোসাইন মৌসুমী, জাতীয় ছাত্রসমাজের সভাপতি সৈয়দ ইফতেখার আহসান হাসান, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিরু। জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার সঞ্চালনায় কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়াও জেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম বাছেদ, সহসাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক মিয়া, ফররুখ আহমেদ প্রমুখ জেলা ও উপজেলার নেতা বক্তৃতা করেন। উপস্থিত ছিলেন চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা নাজমা আক্তার, সহসভাপতি হিনা খান পন্নী, নুরুল ইসলাম নুরু, জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, জাতীয় শ্রমিক পার্টির সভাপতি একেএম আশরাফউজ্জামান প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.