সাধারণ মানুষই সত্যিকার বিজ্ঞ

এ কালের রাজনৈতিক নেতারা কতটা একাডেমিক দিক থেকে রাজনীতি চর্চা করেন বলতে পারব না, তবে ঐতিহাসিকভাবেই এ দেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতিসচেতন। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আড্ডা তাদের খুব প্রিয়। এর উৎস সম্ভবত দেশপ্রেম। বাঙালির এ দেশপ্রেম দেখে কোনো এককালে কবি এ দেশবাসীর মানসিকতাকে অনুভব করে লিখেছিলেন ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী’। খ্রিস্টপূর্ব যুগে বিদেশি আর্যদের আগমন রুখে দিয়েছিল বাংলার সাধারণ মানুষই। পরে ভারতীয় মৌর্য রাজাদের বিজয় অভিযানের ফাঁকফোকর দিয়ে আর্য অনুপ্রবেশ ঘটে। অর্থাৎ রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতায় এ পরাজয় মানতে হয়েছে, কিন্তু পরাভব মানেনি সাধারণ মানুষ। এমন ইতিহাস বারবারই ফিরে এসেছে। ১৯৭১ পর্যন্ত তো প্রত্যক্ষই করেছি। এরপর থেকে সাধারণ মানুষের শক্তিকে আমলে আনেননি শাসক আর রাজনীতিকরা। দলীয় বৃত্তে নিজেদের জগৎ সাজিয়েছেন। তবে জাতীয় নির্বাচনগুলোর দিকে তাকালে বলতে হবে মানুষ প্রয়োজনের সময় ঠিক বিচারই করতে জানে। শুধু গণশক্তির প্রতি সম্মান জানাতে ভুলে যান আমাদের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা। তাই তারা অবলীলায় উচ্চকণ্ঠে বলতে পারেন অমুক দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছে ‘র’ বা ভারত, অমুক দলকে বসিয়েছে মার্কিন শক্তি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভোটের কোনো মূল্যই যেন নেই। তাহলে কেন বলা হয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল ঘটায় সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে? আর না হলে দোষারোপের রাজনীতিকে সঠিক ধরে নিলে বলতে হবে আমাদের রাজনীতিকরা স্বীকার করছেন দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে সাধারণ মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন এ যুগের রাজনীতিকরা।
যা শুরু হয়েছে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে। যাক, এ আলোচনায় এখন যাব না। যে কারণে এ প্রসঙ্গের অবতারণা সেখানে আসছি। দিন দুই আগের কথা। কলাবাগান থেকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাচ্ছিলাম নিমতলী এশিয়াটিক সোসাইটিতে। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত জ্যামে অপেক্ষা করছিলাম। মাঝবয়সী ড্রাইভার একটু উসখুস করছিলেন। মনে হচ্ছিল কিছু বলতে চান। তারপর শুরু করলেন বাঙালির প্রিয় বিষয় রাজনীতি। তার আলোচ্য বিষয় রাজশাহী, সিলেটসহ নানা জায়গায় মেয়র ও চেয়ারম্যানদের মতো জনপ্রতিনিধিদের সাময়িক বরখাস্ত করা এবং আদালতের রায়ে স্থগিত আদেশ উঠিয়ে নিতে বাধ্য হওয়া ইত্যাদি। সূচনাটিতে আমি আনন্দ পেলাম। আমি খুব আগ্রহের সঙ্গে রিকশায় বসে রিকশাচালকের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, পথের পাশের চায়ের দোকানে আলোচনার ঝড়, বাসে উঠলে যাত্রীদের মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক কান পেতে শুনি। বোঝার চেষ্টা করি সাধারণ মানুষের চিন্তা, ব্যাখ্যা, মূল্যায়ন। আর এ সবের কিছু নির্যাস আমি আমার পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিই। মাঝে মাঝে ভাবি আহা আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা রাজনীতিকরা যদি এসব শুনতেন, তবে তাদের নীতিনির্ধারণ করা কত সহজ হয়ে যেত। অবশ্য যদি জনমানসের প্রতি তারা শ্রদ্ধা পোষণ করেন। বুঝলাম ড্রাইভার সাহেব বেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। বললেন ‘স্যার, মানুষ কি রাজনীতি বুঝে না? ব্যাটারা (মেয়র সাহেবগণ) মানুষের ভোটেই তো পাস করছেন। তারা অপরাধ করলে কেস কাবারি থাকলে নির্বাচন করতে দিল কেন? আর মেয়র আমলে সন্ত্রাস করলে বরখাস্ত কেন- সরাসরি এরেস্ট করতে পারতো। তাইলে তো এমনিতেই বরখাস্ত হইয়া যাইতো। জনগণের ভোটে যারা পাস করে তাদের সম্মান না দিলে জনগণের মূল্য কি থাকে! বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তখন আওয়ামী লীগের নেতারা কে কতবড় সন্ত্রাসী তা সামনে আনা হইবো। তখন এগো বিরুদ্ধেও কেস কাবারি হইবো। আমরা খালি এইসব খেলাই দেখুম?’ এবার মনে হয় একটি দীর্ঘশ্বাস আড়াল করলেন।
বললেন, ‘কী বলুম স্যার, আমরা বংশ ধইরা আওয়ামী লীগরে সাপোর্ট করি। এখন তো অন্যদের নানা প্রশ্ন শুনতে হয়। শেখ হাসিনার তো এমন চিন্তা করার কথা না। তারে কি ভেতরের কেউ ডুবাইতাছে? চিরদিন কি কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারে? মানুষের মন যে কখন ঘুইরা যায় কে বলতে পারে।’ আমি অনেকক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলাম ড্রাইভার সাহেবের ক্ষোভ বা মনকষ্টের গভীরতা। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগ ঘরানার মানুষ বললেন। আমার মনে হয় বিএনপির সমর্থক সাধারণ মানুষও বোধহয় বিবেকের শাসন না মেনে রোবটের মতো দলীয় কথা বলেন না। সাদা চোখে বিশ্লেষণ করতে জানেন। সংকট বেশি নেতানেত্রীদের মধ্যে। তারা বিবেক, যুক্তি ও সত্যতা একপাশে রেখে দলীয় বক্তৃতা দিতে থাকেন। আবার দলীয় ঘরানার তথাকথিত সুশীল সমাজের মানুষও যার যার দলের গাইড ফিলোসফার হয়ে সত্যকে সত্য বলে দলীয় নেতৃত্বকে সুপথে আনার চেষ্টা করেন না। বরং নেতানেত্রীদের দোহারের ভূমিকা পালন করেন। এ দেশের মুক্তচিন্তার সবার কাছেই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে জনগণের দেয়া ভোটে জেতা জনপ্রতিনিধিদের প্রায় লাগাতার বরখাস্তের এমন নজির কেন তৈরি করছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার? এমনই অভিযোগ যে বরখাস্তের আদেশ উচ্চ আদালতে গিয়ে ধোপেই টিকছে না! আজকের এমন শক্ত অবস্থানে থাকা আওয়ামী লীগ কেন সাধারণ মানুষের কাছে অহেতুক নিজেকে সমালোচিত হওয়ার পথ করে দিচ্ছে আমার বোধগম্য নয়। তাহলে কি সরকার কোনো দিক থেকে নিজেদের অনিরাপদ মনে করছে? যদি তাই হয় তাহলে আত্মসমালোচনায় যেতে হবে নেতানেত্রীদের। কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সম্মেলন কতটা বাহ্বা দিল বা কোন দেশের পত্রিকা ভূয়সী প্রশংসা করল তা প্রচার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েই নিশ্চিন্তে থাকা যাবে না।
সাধারণ মানুষের কাছে কতটা বিশ্বস্ত হওয়া যায় এটি বড় কথা। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলকে নিয়ে আমাদের একই আফসোস। আবার বিএনপির ক্ষেত্রে যে ভুল মানায়, আওয়ামী লীগের তো তা মানিয়ে যায় না। তারপরও দেখা যায় বৃত্ত একই। বিএনপির ক্ষেত্রে অনেক আফসোস করে অনেকবারই লিখেছি যে, একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম ইতিহাস যাই থাক না কেন, যে কারণেই হোক দেশজুড়ে দলটির অসংখ্য কর্মী-সমর্থক আছে। যারা দলকে ভালোবাসে। শুধু নেতৃত্বের দুর্বলতা আর গঠনমূলক আদর্শ নিয়ে চলতে না পারায় আজ দলটির ক্ষয়িষ্ণু দশা। কেবল প্রগলভ বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে আটকে আছে দলটি। এসব বক্তব্য আমার ধারণা বিএনপির সমর্থকদেরও বিরক্তি উৎপাদন করে। শুধু মির্জা ফখরুল ও রিজভী আহমদরা বুঝতে চান না। আওয়ামী লীগ তো পোড় খাওয়া দল। অনেক বিদগ্ধ নেতানেত্রী আছেন এ দলে। এ ঐতিহ্যবাহী দলটি তো একটি জনকল্যাণকামী আদর্শ নিয়ে বেড়ে উঠেছিল। দেশজুড়ে এ দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা আমাদের ধারণা বিএনপির চেয়ে কম। তা ছাড়া গত দুই প্রস্থে আওয়ামী লীগের শাসনামলকে মানুষ স্বাগত জানায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি তো মানুষকে বলে বোঝাতে হবে না। এ যুগের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যেমন অপ্রয়োজনে বিএনপির শাসনামলের সঙ্গে তুলনা করে নিজেদের বড় দেখাতে চায়, সাধারণ মানুষ তেমনটা করে না।
বিএনপির সূচক সাধারণ মানুষের বিচারে অনেক নিচেই আছে। আওয়ামী লীগপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিএনপির প্রতি একটি আলাদা ক্ষোভ থাকতেই পারে। বিএনপির প্রতি বিবেকবান সাধারণ মানুষের ক্ষোভও কিছু কম নয়। ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা থেকে বিএনপিকে মুক্ত করতে পারবে না মানুষ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার নামে পেট্রলবোমায় মানুষ হত্যা আর সম্পদ ধ্বংসের দায় থেকে মুক্তমনা বিএনপির সমর্থকও নিজ দলকে অভিযুক্ত করবে। ফলে আজকের ক্ষমতার সুবিধায় বিএনপিকে সংকটে ফেলার সুযোগ আওয়ামী লীগ ছাড়বে কেন! তারপরও মানুষ আওয়ামী লীগের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক আচরণ আশা করবে- যে প্রত্যাশা বিএনপির কাছ থেকে করা নিরর্থক। অন্তত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এ বিবেচনাটি করা উচিত যে, বৈরী পাকিস্তানি শাসক চক্রের অক্টোপাশ থেকে বাঙালিকে রক্ষার জন্য সোহরাওয়ার্দী-মওলানা ভাসানির মতো নেতারা আওয়ামী মুসলিম লীগ- অতঃপর আওয়ামী লীগ গড়ে ছিলেন। একসময় দলের প্রাণপুরুষ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির মুক্তি ও সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল যে দল, আজ সে দলের অগণতান্ত্রিক নীতিনির্ধারণ সত্যিই খুব বেদনার। ইতিহাস তো কাউকে ক্ষমা করে না। ইতিহাস থেকেই তো আমরা আওয়ামী লীগের অতীত গৌরব জানি।
উত্তরকালের মানুষও ইতিহাস থেকেই এ যুগের আওয়ামী লীগকে জানবে। আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগ এখনও অনেক সবল অবস্থানে আছে। বিএনপিভীতি তাড়িয়ে বেড়ানোর মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। সুতরাং ক্ষমতায় থাকা একটি গণতান্ত্রিক দলের যেমন আচরণ শোভন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে আমরা তেমন আচরণই আশা করি। সেই অটোচালকের মতো করেই আমরা বলতে চাই। কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি বা অন্য কোনো অপরাধে মামলা থাকলে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। অথবা নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর সুনির্দিষ্ট অপরাধে মামলা রুজু হলে তিনি গ্রেফতার হতে পারেন। কিন্তু যেসব অপরাধের অভিযোগ সর্বোচ্চ আদালত আমলে নেন না, সেসব আচরণ করে দল ও সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করা কেন? জনগণের ভোটে নির্বাচিত যে কোনো স্তরের জনপ্রতিনিধিদের অসম্মান করা জনগণকেই অসম্মান করার শামিল, এ সত্য বুঝতে না পারলে ভবিষ্যতে তা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.