১২০ প্রাণ ঝরল যে নির্বাচনে by আবু সালেহ আকন

১২০ প্রাণ সংহারের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। গতকাল শনিবার শেষ দফার নির্বাচনেও প্রাণ যায় চারজনের। মোট ছয় ধাপের নির্বাচনে আহত হয়েছেন ১২ হাজারের বেশি মানুষ। এর মধ্যে অনেকেই জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ইতিহাসের সবচেয়ে সহিংস এবারের ইউপি নির্বাচন। এত হানাহানির নির্বাচন এ দেশে অতীতে হয়নি। গতকাল শেষ দফার নির্বাচন শেষ হলেও নির্বাচনকেন্দ্রিক আরো প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। গতকালের হানাহানির রেশ আরো কয়েক দিন থাকতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সহিংসতারোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন বলে বিভিন্ন সময় অনেকেই মন্তব্য করেছেন।  নির্বাচনের দিন, নির্বাচন-পূর্ববর্তী ও নির্বাচন-পরবর্তী সহিংস ঘটনায় এসব প্রাণহানি হয়। এর মধ্যে কিছু রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহতের ঘটনা। সহিংস ঘটনায় প্রকাশ্যে এ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হতে দেখা গেছে।
এমনকি কোন কোন এলাকায় বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। গত ২২ মার্চ প্রথম ধাপে ৭১২টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ধাপের নির্বাচনের দিনে বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয় ১১ জন এবং আহত হয় হাজারের ওপরে। নির্বাচনের পরের দুই দিনে ও নির্বাচনের দিনে আহত আরো তিনজনসহ প্রথম ধাপের নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ছয়জন। তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের আগেই সারা দেশের অনেক এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয় ১০ জন। সব মিলিয়ে প্রথম ধাপে নিহত হয় ২৭ জন এবং আহত হয় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৩১ মার্চ। ওই দিন সাত উপজেলায় সহিংসতায় এক শিশু, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রসহ আটজন নিহত হয়। নির্বাচনের আগে-পরে ও নির্বাচনের দিন মিলিয়ে দ্বিতীয় দফা শেষে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৭ জনে। গত ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় দফার নির্বাচন। ওই দিন বাগেরহাট সদর ও শরীয়তপুরের নড়িয়ায় দুইজন নিহত হন। বিভিন্ন এলাকায় ব্যালট ছিনতাই ও সংঘর্ষে আহত হয় দুই শতাধিক। তৃতীয় দফার আগে-পরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় তৃতীয় দফা নির্বাচন শেষে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৭ জন।
আহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫ হাজার। ৭ মে অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ ধাপের নির্বাচন। এ দিন পাঁচজন নিহত হয়। এর মধ্যে রাজশাহীর বাগমারায় দুইজনসহ নরসিংদী, কুমিল্লা ও ঠাকুরগাঁওয়ে একজন করে মোট পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়াও জামালপুরে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকালে নিজ গুলিতে একজন বিডিআর সদস্য নিহত হন। চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হন ৯০ জন এবং আহতের সংখ্যা ছয় হাজারেরও বেশি। ২৮ মে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম ধাপের নির্বাচন। এই নির্বাচনেও ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটে দেশের বিভিন্ন স্থানে। পঞ্চম দফার নির্বাচন শেষে হিসাব করে দেখা যায় নিহতের সংখ্যা ১১১। এর মধ্যে কিছু রয়েছেন, যারা বিভিন্ন ধাপের সহিংসতায় আহত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা যোগ হয়। এ ছাড়া ওই দিন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার শাহপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচনী সহিংসতায় আহত আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম কালু মারা গেছেন।
সর্বশেষ গতকাল ৪ জুন অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠ ও শেষ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। শেষ ধাপে দেশের ৪৬ জেলার ৯২ উপজেলার ৭১০টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গতকালও ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে শাজাহান (৫২), সোনাগাজীতে নাসির (১৮) এবং নোয়াখালী সদরে আরাফাত (২৩) নামে তিনজনের প্রাণ গেছে। শেষ ধাপের নির্বাচনের আগে নিহত হয়েছেন আরো চারজন। এর মধ্যে নড়াইলের লোহাগড়ায় গত ২ জুন নিশান মুন্সি এবং গোবিন্দগঞ্জে একজন নিহত হন। ১ জুন নরসিংদীর রায়পুরায় সরকারদলীয় প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিতে নিহত হন লিটন মিয়া নামে এক পথচারী। ৩ জুন চট্টগ্রামের আনোয়ারায় নিহত হন ফারুক নামে এক যুবক। অনুসন্ধানে দেখা গেছে নির্বাচন-পূর্ব সংঘর্ষে ৪৯ জন, ভোটের দিন সংঘর্ষে ৪৯ জন এবং ভোটের পর সংঘর্ষে ২০ জন নিহত হন। এর আগে দেশে ১৯৮৮ সালের নির্বাচন সবচেয়ে বেশি সহিংস ও প্রাণঘাতী ছিল। ওই নির্বাচনে ৮০ জনের প্রাণহানি হয়। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইউপি নির্বাচনে ১০ জনের প্রাণহানি হয়। ২০০৩ সালে বিএনপি সরকারের আমলে ২৩ জন মারা যায়। এবারে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.