সবুজের সমারোহ রাঙ্গামাটিতে

কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে তার আদ্যোপান্ত জেনে নেয়া ভালো। এতে দেখার তালিকায় বাদ পড়বে না কিছুই। বোনাস হিসেবে সময়টা উপভোগ করা যাবে উৎকণ্ঠাবিহীন। রাঙ্গামাটি ভ্রমণের আগে আমরাও সেটা করেছিলাম ভ্রমণ শুরুর বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই। কিন্তু চট্টগ্রাম শহর থেকে রাঙ্গামাটির পথে ৩০-৩৫ কিলোমিটার অতিক্রম করার পরও মনের মধ্যে কল্পনার রঙে আঁকা গন্তব্যের মিল না দেখে একজন মন্তব্য করে বসলেন, এ রকম বিস্তীর্ণ সমতলভূমি দেশের বেশির ভাগ এলাকাতেই রয়েছে। ঋতুভেদে গ্রামবাংলার রূপ যারা ভালোভাবে দেখেছেন, তাদের জন্য এ ধরনের জায়গা আকর্ষণ করতে পারবে না। এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ির জানালার ফোকর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আশপাশটা দেখতে দেখতে এগোতে থাকলাম। গুগল ম্যাপে একজন দেখছেন, রাঙ্গামাটি শহরের দূরত্ব কত বাকি। গাড়িতে থাকা অন্যরাও একে অন্যকে জিজ্ঞেস করছেন, সময় আর কত লাগতে পারে। অর্থাৎ সময়টা খুব ভালভাবে কাটছে না সেটা বোঝা যাচ্ছিল। এর মিনিট বিশেক পরই পাল্টে গেল অবস্থা।
সমতলভূমি পর গাড়ি প্রবেশ করল পাহাড়ি এলাকায়। গুমোট অবস্থা ভেঙে কয়েকজন উঠে দাঁড়ালেন জানালার বাইরে মাথা নেয়ার জন্য, যাতে করে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ মনের মধ্যে ভালোভাবে গেঁথে রাখা যায়। অবশ্য গাড়ি পাহাড়ের যে পাশ দিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকে নিচে তাকালে হঠাৎ কেউ ভয়ও পেয়ে যেতে পারেন। গাড়ি যে দিক দিয়ে যাচ্ছে, তার থেকে সমতল ভূমি অনেক নিচে। দূরের পাহাড়ি বসতিগুলো দেখলে মনে হবে খেলাঘর। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা রাঙ্গামাটিতে এই আনন্দকে বোনাস হিসেবে ধরে নেয়া ভালো। কারণ সবুজে ঘেরা পর্যটন ওই জেলা শহরে এটাকে বলা যায়, মূল সৌন্দর্যের সংবর্ধনা। পর্যটকদের এখানকার যেসব জায়গা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তা হলো কাপ্তাই হ্রদ, পর্যটন মোটেল, ডিসি বাংলো, ঝুলন্ত ব্রিজ, সাজেক, পেদা টিংটিং, সুবলং ঝরনা, রাজবাড়ি, রাজবন বিহার, উপজাতীয় জাদুঘর, কাপ্তাই হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্ট, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান। রাঙ্গামাটিতে আমরা উঠেছিলাম পর্যটন মোটেলে।
এখানে ডাবল বেডের রুম ননএসি দুই হাজার ২০০ টাকা। আর এসিতে তিন হাজার ২০০ টাকা। অবশ্য পাশের পুরনো মোটেলে উঠলে আরেকটু কম খরচে এসি রুম পাওয় যাবে দুই হাজার ৯০০ টাকায়। পর্যটনে থাকার সুবিধা হলো, ভোরের নরম নীলাভ আলোয় চোখের সামনেই পাবেন ঝুলন্ত ব্রিজ। চার পাশে পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। রাঙ্গামাটিতে সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটবে কাপ্তাই লেকে নৌকায় ভ্রমণের সময়। স্বচ্ছ টলমল পানিতে যখন নৌকা চলবে, মনে হবে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। সিলেটে গেলে যারা প্রতিবেশী দেশের পাহাড় দেখে আফসোস করে বলেন, ‘ওই বড় পাহাড়গুলোতে যদি যাওয়া যেত!’ তাদের জন্য সুখবর হলো, কাপ্তাই লেকে যাত্রা শুরুর তিন-চার ঘণ্টা যাত্রা করার সময় চোখে যত দূরের পাহাড়ই পড়–ক না কেন সবই বাংলাদেশের।
তবে প্রকৃতির মাঝে ভাসমান একটি পাহাড়ি দ্বীপে পেদা টিংটিং (একটি চাকমা শব্দগুচ্ছ, যার অর্থ হচ্ছে পেট টান টান) রেস্তরাঁয় খাবারের পরিবেশ ছিল মনোমুগ্ধকর। এই দ্বীপে যতক্ষণ থাকা যাবে, মনে হবে নিজের পরিচিত পরিবেশ থেকে অনেক দূরের কোনো স্বপ্নের জায়গায় চলে এলাম। তবে এই স্বপ্নে বিভোর হলে চলেবে না, খাবার অর্ডার করার আগে অবশ্যই তালিকার পাশে লেখা দামটার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তা নাহলে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হতে পারে অনেকের। কারণ ওখানকার খাবারের দাম ঢাকার অনেক দামি রেস্তরাঁর চেয়ে বেশি। তবে স্বাদে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবেন সেটা নিশ্চিত। কাপ্তাই লেক : এটি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙ্গামাটি জেলার একটি কৃত্রিম হ্রদ। কর্ণফুলী পানি বিদুৎকেন্দ্রের জন্য ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে রাঙ্গামাটি জেলার ৫৪ হাজার একর কৃষিজমি ডুবে যায় এবং এ হ্রদের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউতাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকরপোরেট ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ ও ৫৪.৭ মিটার উচ্চতার এ বাঁধটি নির্মাণ করে।
এ বাঁধের পাশে ১৬টি পানিকপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা ¯িপ্রলওয়ে রাখা হয়েছে। এ ¯িপ্রলওয়ে প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি নির্গমন করতে পারে। এ প্রকল্পের জন্য তখন প্রায় ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাজেট নির্ধারণ করা হলেও পরে তা ৪৮ কোটি ছাড়িয়ে যায়। প্রথমে এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন মতা ধরা হয়েছিল এক লাখ ২০ হাজার কিলোওয়াট। প্রথমে ৪০ মেগাওয়াট মতাসম্পন্ন ১ ও ২ নম্বর ইউনিট স্থাপন করা হলেও পরে ১৯৬৯ সালের ৫০ মেগাওয়াট মতা সম্পন্ন ৩ নম্বর ইউনিটের কাজ শুরু হয়।
বর্তমানে মোট পাঁচটি ইউনিট চালু আছে যার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনমতা ২৩০ মেগাওয়াট। যেভাবে রাঙ্গামাটি যাবেন ঢাকা থেকে ইচ্ছে করলে সরাসরি রাঙ্গামাটি আসতে পারেন অথবা চট্টগ্রাম হয়েও আসা যায়। চট্টগ্রাম থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৭০ কিলোমিটার। আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে রাঙ্গামাটি প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার। ঢাকার কমলাপুর থেকে এস আলম, শ্যামলী ও ইউনিকসহ বিভিন্ন পরিবহনে যাওয়া যায়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর অক্সিজেন থেকে এক ঘণ্টা পরপর পাহাড়িকা বাস এবং প্রতি আধা ঘণ্টা পর বিরতিহীন বাস ছেড়ে যায় রাঙ্গামাটির উদ্দেশে।

No comments

Powered by Blogger.