বাল্যবন্ধু জিয়া এখন প্রতিবন্ধী

সেই ছোট্টবেলা থেকে জিয়া আমার খুব কাছের একজন মানুষ। যখন ছিল না আমাদের কাসের কোনো নাম। দলবেঁধে যেতাম স্কুলে আর ঘুরেফিরে চলে আসতাম বাড়ি। সেই সময় থেকে এখন অবধি জিয়া আর আমার সম্পর্কটা সেই একই রকম রয়েছে। আমি এখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। আমি যখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, ২০১১ সালের কথা; সেই সময়ই জিয়া হারিয়ে ফেলেছে তার দুই হাত।
একসাথে পড়তাম দু’জনে। কাস সেভেন থেকে দারিদ্র্যের কারণে ছিটকে পড়ে জিয়া। গ্রামের এক রাজমিস্ত্রির সাথে কথা বলে যোগ দেয় রাজমিস্ত্রির কাজে। মন মানসিকতা, কথাবার্তায় জিয়া সেই ছোটো বেলা থেকেই অমায়িক। বাবা-মায়ের খুব আদরের সন্তান জিয়া। আমরা স্কুলে যেতাম আর জিয়া রোজ সকালে রাজমিস্ত্রির কাজে। কোনো দিন সকাল সকাল কাজ শেষ হলে বিকালে দেখা যেত খেলার মাঠে। জিয়া ভালো বল করত। বলের স্পিডও ছিল লাগামহীন।
মাঝে মাঝে গ্রামের বিবাহিত অবিবাহিতদের মধ্যে হা-ডু-ডু খেলা হলে তাতেও জিয়া অংশ নিত। জিয়া খুব ভালো ধরতে পারত। স্কুল প্রাইভেটের চাপে কয়েক দিন দেখা না হলেই রাতে চলে আসত আমার রুমে। আমি পড়তাম আর জিয়া বসে বসে ওর কাজের গল্প বলত। কোথায় কাজ করছে? কাদের বাড়ি কাজ করছে? বাড়িওয়ালারা কেমন? ভালো খেতে দেয় কি নাÑ এমন নানা বিষয়। জিয়া বলতÑ শুনতাম বেশির ভাগ পাকা বাড়িঅলারা কৃপণ টাইপের হয়। বাড়ি ইটের ঘর অথচ মিস্ত্রিদের খেতে দিতে চায় না। আশপাশে কোথাও মেলা কিংবা ঘোড়া দাবড় হলে জিয়া আমাকে নিয়ে যেত মেলায়। মেলায় গিয়ে সব খরচ বহন করত জিয়া। আমি যদিও টাকা দিতে যেতাম, জিয়া কড়া গলায় বলত, ‘এখন আমি রোজগার করি, বিল আমি দেবো। যে সময় তুই চাকরি-বাকরি করবি যখন তুই দিবি।’ তিন বছর রাজমিস্ত্রিতে গোজালে খাটার পরে অবশেষে জিয়া মিস্ত্রি হয়েছিল। স্পষ্ট মনে আছে, সেই দিন রাতে জিয়া সিঙ্গিয়ার হাট থেকে গরম গরম জিলাপি কিনে হাজির হয়েছিল। সারা সপ্তাহ কাজ করত আর হাটের দিন টাকা পেত। পরের তিন বছর জিয়া ফুল মিস্ত্রি ছিল। বেতনও ছিল একটু বেশি। টুকিটাকি করে পয়সাও জমাচ্ছিল। মাঝে মাঝে বিয়ে করার গল্পও শোনাত জিয়া।
আমি সেদিন যশোরে। বাড়ি থেকে আম্মু ফোন করে জানাল, ‘জিয়া রাজমিস্ত্রি কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মরতে বসেছে। বাজারের ভেতরের রাস্তার পাশেই একটি বিল্ডিংয়ের ছাদে কাজ করছিল জিয়া। ছাদ ঢালাই দেবে, তাই নিচ থেকে বড় বড় রড ওপরে উঠাচ্ছিল। কাছাকাছিই ছিল বিদ্যুতের মেইন তার। রড উঠাতে গিয়ে হঠাৎ একটি রড গিয়ে পড়ল মেইন তারের ওপর। চোখের পলকে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো ছিন্নভিন্ন করে দিলো জিয়ার সব কিছু। জিয়ার মনের ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে রাখা সব রঙিন স্বপ্ন মুছে যেতে শুরু করল আস্তে আস্তে। খুলনা আড়াই শ’ বেডের হাসপাতালের ঢাকা মেডিক্যালে শিফট করা হয়েছিল। ডাক্তার জানাল, জিয়ার দ্ইু হাতই ড্যামেজ হয়ে গেছে। তিন দিন পরে জ্ঞান ফিরলেও ডাক্তার বলল, রোগীর অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। তিন মাস ২৭ দিন ঢাকা মেডিক্যালের এ-বেড থেকে ও-বেডে গড়িয়ে গড়িয়ে বাড়ি ফিরল জিয়া। তখন মোটামুটি সুস্থ ছিল। দিনের ভেতর যে জিয়ার মৃত্যুসংবাদ আসে তা কয়েকবার সেই জিয়াকে ফিরে পেয়ে গ্রামের মানুষ লাইন ধরেছিল জিয়াদের বাড়ি। জিয়া বেঁচে আছে কিন্তু জিয়ার দু’টি হাত নেই। যশোর থেকে বাড়ি এসে যেদিন জিয়াকে দেখতে গিয়েছিলাম, সেদিন আমার সাথে কথাই বলতে পারছিল।
চোখ দিয়ে শুধু অঝর ধারায় পানি ঝরছিল। মাস পাঁচেক জিয়া তার সব কাজের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর ছিল। পরে আস্তে আস্তে চেষ্টা করে এখন প্রায় টুকিটাকি সব কাজ করতে পারে। দুই হাতের কনুই পর্যন্ত নাই জিয়ার। এই অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার পরের চার বছরে জিয়া এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আমি বাড়ি এলেই বেশির ভাগ সময় কাজে জিয়াই সাথে থেকে। বিকেলে খেলার মাঠের এক প্রান্তে বসে সেই জীবনের খেলার উইকেট রানের হিসাব-নিকাশ করি। জিয়ার হাত নিয়ে লোকজনের হাসিতামাশা তাকে এখন আর তেমন কষ্ট দেয় না। নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে জিয়া। তবুও মাঝে মাঝে কথায় কথায় বলে ফেলে জিয়া তার স্বপ্নের কথা। এখনো জিয়া স্বপ্ন দেখে তার দুই হাতই ভালো হয়ে গেছে। সব কাজ করতে পারছে আগের মতো। কিন্তু এ স্বপ্ন যে আর পূরণ হওয়ার নয়, সেটা জিয়ারও অজানা নয়। সেই সুস্থ সবল রাজমিস্ত্রি জিয়া এখন প্রতিবন্ধী পদবি ঘাড়ে করে ঘুরে বেড়ায় এখান থেকে ওখানে।
এস আর শানু খান
মাগুরা

No comments

Powered by Blogger.