সাংবাদিকতার আমৃত্যু শিক্ষক by মিজানুর রহমান খান

এবিএম মূসা
বহুদিন মূসা ভাইয়ের ফোন কল পাই না। তবু ফোন কলের তালিকায় নামটা সযতনে রেখে দিয়েছি। লেখার ভুল ধরিয়ে দিতে যাঁদের ফোন পেতাম, এবিএম মূসা তাঁদের অন্যতম ছিলেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে যে কথা বিশেষভাবে স্মরণ করি সেটা হলো, আজ জাতীয় রাজনীতিতে এমন সময় যাচ্ছে, যখন হানাহানিতে ক্লান্ত হয়ে কুশীলবেরা যদি একজন মুরব্বির খোঁজ করেন, তখন চট করে কারও নাম মনে আসবে না। যাঁর একটা আদর্শ থাকবে, নীতি থাকবে, আবার সততার সঙ্গে সাংবাদিকতা করবেন, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলবেন, তেমন ব্যক্তিত্ব সমাজে বিরল। বিরল প্রজাতি হলে জাতিসংঘ তাদের একটা তালিকা করে। রেডবুকে তাদের নাম পাওয়া যায়। কী করে তাদের সুরক্ষা দেওয়া যায়, সে চেষ্টাও চলে। জীব ও উদ্ভিদজগতে এমন অনেক সদস্য আছে, যাদের উপস্থিতি একসঙ্গে অনেকগুলোর স্থায়িত্ব ও টিকে থাকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুসা ভাই ছিলেন সেই বিরল প্রজাতির একজন। তিনি বেঁচে থাকলে কেবল সাংবাদিকতাই নয়, তার থেকে বেশি রাজনৈতিক জগতেও হয়তো নতুন করে প্রাণস্পন্দন আনতে পারতেন। একসময় আমি পেশাগত বিশুদ্ধবাদিতা অপরিহার্য মনে করতাম। সেটা প্রধানত এই বিবেচনায় যে, মূসা ভাই কেন একটি দলের সংসদ সদস্য হবেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আওয়ামী লীগের সাংসদ, নাকি সাংবাদিক—কোন পরিচয় আপনাকে গৌরবান্বিত করে? উত্তরে তিনি বোধগম্য কারণেই সাংবাদিকতার পক্ষ নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে যা আজ আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো একটি দলের খাতায় নাম ওঠানো আর সাংবাদিকতা পেশার ন্যূনতম রীতিনীতি বিসর্জন দেওয়া এক নয়। নিশ্চয় এমন অনেক বিষয় ছিল, যার সঙ্গে মুসা ভাইয়ের মত বা অবস্থানকে যৌক্তিক মনে হতো না, কিন্তু তাই বলে তাঁর মত তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া দুরূহ ছিল। মূসা ভাই ভিন্নমতে বিশ্বাস করতেন। তিনি এটা বিশ্বাস করতেন যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটা আপসরফা থাকতে হবে। আর এই আপসরফার জন্য তিনি মৃত্যুর শেষ দিনগুলোতেও সম্ভবত চোখ-কান খাড়া করে রেখেছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একতরফা হোক, সেটা তিনি চাননি। তার অর্থ কোনোক্রমেই এই নয় যে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের প্রতি অঙ্গীকারে তাঁর কোনো ঘাটতি পড়েছিল বা সেখানে কোনো চিড় ধরেছিল। তিনি তাঁর আওয়ামী লীগের মিত্র ও স্নেহভাজনদের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাইতেন যে তাঁর সংকল্পে কোনো ফাটল নেই। কিন্তু বিরোধী দল ও ভিন্নমতের প্রতি আওয়ামী লীগের অসহনশীলতাকে তিনি মেনে নেননি। কারণ, সেটা একদিন না একদিন আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে অবশ্যই মূসা ভাই তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে একজন অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে চেয়েছিলেন। সেটাকে কেউ স্বনিয়োজিত ট্রাফিক পুলিশিং বলতে পারেন। আমরা আশা করব মূসা ভাইয়ের সেই শূন্যস্থান কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ দ্রুত পূরণ করে দিতে সচেষ্ট হবেন। মূসা ভাই নিশ্চয় রাজনীতিক হতে চাননি। তিনি সাংবাদিকতাকেই ভালোবেসেছেন। সেটাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। কারও লেখা ভালো লাগলে তিনি যেমন অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেন, তেমনি কোনো প্রতিবেদনে তথ্যগত ভুল থাকলে ধরিয়ে দিতেন। এমনকি কোন খবরটি কোন পাতায় হওয়া উচিত সে সম্পর্কেও স্পষ্ট মতামত দিতেন মূসা ভাই। বলা যায়, তিনি ছিলেন সাংবাদিকতার আমৃত্যু শিক্ষক। কঠিন সেন্সরশিপের মধ্যে কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করে সত্য প্রকাশ করা যেত, তার অনুকরণীয় নজির হয়ে আছেন মূসা ভাই।  তিনি তাঁর পেশাগত জীবনের গোড়া থেকেই মেধা ও দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। সব সময় উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলিতে কুশলী সাংবাদিকতার ছাপ রাখতেই সচেষ্ট থেকেছেন। ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবেও তাঁর মনে একটা গর্ব ছিল। যেমন আমাকে বলতেন, তোর সঙ্গে আমার একটা মিল আছে। কী মিল? আমি কখনো ক্রীড়া সাংবাদিকতার খাতায় নাম লেখাইনি। আর আপনি তো ক্রীড়া সাংবাদিকই হতে চেয়েছিলেন। মূসা ভাই হেসে বলেছেন, তুই আদালতের খবর যেভাবে লিখিস, সেভাবে ক্রীড়া সাংবাদিককেও প্রখর নজর রাখতে হয়। অন্য অনেক বিষয়ের সাংবাদিকেরা প্রায় ১০টি বা আনুমানিক বা মোটামুটি বলে খবর পরিবেশন করতে পারেন। কিন্তু এই দুটি ক্ষেত্রে একদম তা চলবে না। কয়টি গোল বা রান হয়েছে আর জজ সাহেব ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন কি দেননি, সেখানে কোনো প্রায় বা অনুমানের বালাই নেই। সংবিধান ও বিচার বিভাগ নিয়েও মূসা ভাইয়ের আগ্রহ ছিল। কোনো কলাম লিখতে বসে তাঁর ফোন পেতাম। তাঁকে দ্রুত কোন আইনের কোন ধারায় কী আছে, সেটা সরবরাহ করতে হতো। আমি এসব তাঁকে সরবরাহ করতে পেরে আনন্দিত হতাম। তিনি এমনভাবে ঐতিহাসিক ঘটনা ও পরম্পরা বর্ণনা করতেন যে আমরা অবাক হতাম। আমি কয়েকটি দিন টেপ রেকর্ডার হাতে ঘুরছিলাম এই আশায় যে, তিনি এমন একটা সাক্ষাৎকার দেবেন, যা আগে তিনি কখনো প্রকাশ করেননি। অথচ নীরব সাক্ষী ছিলেন। কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন কি? জানি না। কেউ দেখে ফেললে কী ভাববে, সেই ঝুঁকি নিয়েও মৃত্যুর ৪৮ ঘণ্টা আগেও টেপ নিয়ে গিয়েছিলাম। মূসা ভাই দূর অতীত বলেননি। নিকট অতীতের কয়েক ছত্র বলেছিলেন। আর সেটা সংলাপ নিয়ে। একটি বাড়িতে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ তাঁকে আসতে বলেছিলেন, তাঁরা যেকোনো বিবেচনাতেই হোক ৫ জানুয়ারির আগে বিএনপির সঙ্গে একটা মধ্যস্থতা চেয়েছিলেন। সেটা একটা সুতো কিংবা সলতে। 
আমরা মূসা ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, কারণ আমরা মনে করি মূসা ভাই আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিলেমিশে আছেন, আর আছে সেই সলতেটা, যেটা জ্বালাতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপস না করেই মূসা ভাই যে ঐক্যের সলতে জ্বালাতে চেয়েছিলেন, তার প্রজ্বলন কামনা করি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.