বিশ্বায়ন নয়, চাই বাংলায়ন by সৈয়দ আবুল মকসুদ

আমাদের যাদের জন্ম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের শেষ দিকে, তাদের শৈশবের যে বাংলাদেশ, সে এক অন্য রকম বাংলাদেশ। গত ৫০-৬০ বছরে এ দেশের ভূপ্রকৃতি ও সমাজে এতটাই পরিবর্তন ঘটেছে যে মনে হয় সে যেন কয়েক শতাব্দী আগের এক ভূখণ্ড। নেই সেই নদ-নদী, ঝোপঝাড়, গাছপালা, ফসলের মাঠ এবং মানুষের জীবন; এমনকি নেই সেই প্রাণিজগৎ পর্যন্ত। শুধু গ্রামাঞ্চলে নয়, এই নগরীতেই ছিল কত বেজি ও শিয়াল। সন্ধ্যার পর আজিমপুর, হাজারীবাগ, পিলখানার দিক থেকে শোনা যেত অনেক শিয়ালের সমস্বরে হুক্কা হুয়া। যানবাহন বিশেষ না থাকায় হঠাৎ হঠাৎ রাস্তা পার হতো বেজি, গুইসাপ নির্ভয়ে। বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের মানুষের সর্বজনীন উৎসব। সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। এই উৎসবে সব ধর্মের কিছু কিছু উপাদানও ছিল, তবে লোকায়ত উপাদানই প্রধান। শুধু বাঙালি নয়, এই নববর্ষের উৎসবে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষেরও। বরং এই একটিমাত্র উৎসবই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির সঙ্গে তারা আনন্দ উপভোগ করতে পারত। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল হালখাতা ও গ্রামীণ বৈশাখী মেলা। বাংলা নববর্ষ শুধু একটি লোকজ সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, এর অর্থনৈতিক তাৎপর্য ছিল বিরাট। গ্রামীণ অর্থনীতিতে হালখাতা ও বৈশাখী মেলার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ সাগর ও নদ–নদীর পলিমাটি দিয়ে গঠিত। সমতল ভূমি অতি উর্বর। সমাজ কৃষিভিত্তিক। কবিরা যাকে বলে থাকেন সুজলা সুফলা, শস্য শ্যামলা। এ দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ইরান, সৌদি আরব, লিবিয়া, সিঙ্গাপুর বা সুইজারল্যান্ডের মতো হবে না। হাজার বছর ধরে বাংলার জীবন, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি আবর্তিত গ্রাম ও কৃষিকে কেন্দ্র করে। এবং এ দেশের কৃষি সভ্যতার যে সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য, তা পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলের সঙ্গে তুলনীয় নয়। অন্যান্য দেশে নববর্ষে হালখাতা হয় কি হয় না, তা আমার জানা নেই এবং তা আমার গবেষণার বিষয় নয়। আমি স্বাধীনতার আগে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরে বাংলা নববর্ষে হালখাতা হতে দেখেছি। এবং তা দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের বাজারে, মৌলভীবাজার-চকবাজারের খুব বড় ব্যবসায়ী থেকে পাড়াগাঁয়ের ছোট্ট মুদি দোকানদার পর্যন্ত; হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধনির্বিশেষে সবাইকে হালখাতা করতে দেখেছি। করতে শুধু দেখিনি, তাতে অংশ নিয়েছি ও উপভোগ করেছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে তা হারিয়ে গেল কেন? হালখাতা ছিল একটি সামাজিক উৎসব। তার সামাজিক উপযোগিতাও ছিল অসামান্য। চৈত্রসংক্রান্তির দিন বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঝাড়া-মোছা করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হতো। যেন বাধ্যতামূলক পরিচ্ছন্নতা অভিযান। পরদিন হতো সেই দোকানে ও প্রতিষ্ঠানে নববর্ষের হালখাতা। অজপাড়াগাঁয়ের ছোট দোকানদার থেকে গঞ্জের বড় পাইকারি ব্যবসায়ী পর্যন্ত পরিচিত ব্যক্তিদের রঙিন কাগজে ছাপানো চিঠি দিতেন নববর্ষে তাঁর প্রতিষ্ঠানে পদধূলি দিতে এবং আশীর্বাদ করে আসতে। খুব বড় দোকানদার নিজের নামে আলাদা আমন্ত্রণপত্র ছাপতেন। তা ছাড়া ছাপা আমন্ত্রণপত্র চকবাজারে কিনতে পাওয়া যেত। তাতে ফাঁকা জায়গায় নিজের ও আমন্ত্রিতের নামটা হাতে লিখে দিলেই হতো। দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান সাজানো হতো রঙিন কাগজ ও ফুল দিয়ে। আমার আব্বা বিভিন্ন দোকান ও প্রতিষ্ঠান থেকে আমন্ত্রণপত্র পেতেন। সব জায়গায় তাঁর যাওয়া সম্ভব হতো না। ছোটবেলা আমি ও পরিবারের অন্য কেউ তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতাম। তবে কোথাও খালি হাতে যাওয়া যেত না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কিছু টাকা দিতে হতো। আমাদের নাম ও টাকার পরিমাণ একটি খেরোখাতায় লিখে রাখা হতো। পরে কোনো জিনিস কিনে তা উশুল হতো। তবে সেই টাকার পরিমাণ কত? আমার মনে পড়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দু-তিন টাকার বেশি সেলামি দিতাম না। প্রতিটি দোকানেই কিছু মিষ্টিমুখ করতে হতো। একটি পিরিচে রসগোল্লা, সন্দেশ, বাঙ্গি, তরমুজ, পেঁপে, কলা প্রভৃতি। অর্থনীতি ও সামাজিকতার মিলন। কোথায় আজ সেই বাঙালির নববর্ষের হালখাতা? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দীর্ঘদিনের উপনিবেশিত যেসব দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে, তার সবই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফসল। স্বাধীনতার পর এসব দেশ শুধু অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই যে লড়াই অব্যাহত রাখে তা-ই নয়, জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কীভাবে আরও বেশি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা যায় তার জন্যও সচেষ্ট হয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর অল্পসংখ্যক দেশের একটি যে তার জাতীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অতি দ্রুত খোয়াতে থাকে, বাঙালি বিদ্বান সাংস্কৃতিক কর্মীদের যাঁরা মনে করেন প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গান গাইলেই বাঙালি সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও বিকশিত হলো, তাঁরা বাঙালির সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অবহেলা শুধু নয়, অবিচার করেন। জাতীয় সংস্কৃতির শীর্ষ প্রতিভা এক জিনিস। তাঁদের তো অবহেলা করা যাবেই না, কিন্তু তাঁরাই সব নন। নদীর মূল স্রোতের সবচেয়ে পরিষ্কার পানিই নদী নয়, কাদামাটিমিশ্রিত সবটা পানি নিয়েই নদী। একটি-দুটি ফলভারনত বৃক্ষ দিয়ে ফলের বাগান হয় না, তাকে ফলের গাছ বলা যেতে পারে। বাঙালি সংস্কৃতির মূল ভিত্তি গ্রামে। নগরের পরিশীলিত শিল্প-সাহিত্যের মর্যাদা আলাদা।
কোনো রাষ্ট্রের মধ্যম বা উচ্চ আয়ের দেশে প্রমোশন পাওয়ার সঙ্গে তার সুদীর্ঘ ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিসর্জন দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের চৌদ্দপুরুষ কোনো দিন কানেও শোনেনি যে বাংলা নববর্ষে ইলিশ মাছ দিয়ে মাটির সানকিতে পান্তাভাত খেতে হয়। বাঙালি সেই সীমা লঙ্ঘনে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। গ্রামীণ গরিবদের সঙ্গে পরিহাস। আশির দশকের প্রথম দিকে জেনারেল এরশাদের শাসনামলে কোনো কোনো কোল্ড স্টোরেজের মালিক তাঁদের মজুত করা ইলিশ বেশি দামে বাজারে ছাড়ার মতলবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্কের মাঝের মাওলানা ভাসানী সড়কে পান্তা-ইলিশের প্রবর্তন করেন। হঠাৎ করে দেখা গেল দামি গাড়ি নিয়ে বিত্তবানেরা লাইন ধরে পান্তা-ইলিশ খাচ্ছেন সকালবেলা। সাধারণ মধ্যবিত্তের একটি বিচার-বিবেচনাবর্জিত অংশও ওই লাইনে গিয়ে সানকি হাতে দাঁড়িয়ে গেল। বাঙালি সংস্কৃতির নামে বাঙালির চিরকালের সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানা হলেও মাছ ব্যবসায়ীদের কল্যাণ প্রথাটি টিকে যায়। প্রশ্নটি তখনই আমার লেখায় তুলেছিলাম কিন্তু কেউ গ্রাহ্য করলেন না। অর্থনৈতিক দিক থেকে পান্তা-ইলিশ যে কত বড় আত্মঘাতী কর্ম তা নির্বোধ ছাড়া প্রত্যেকেই জানে। ফাল্গুন-চৈত্র ইলিশের প্রজননের সময় এবং এই সময় যে মাছ বাড়তে থাকে, সেগুলোই আষাঢ়ে পরিপূর্ণ হয়। এই পান্তা-ইলিশের কারণে জাটকা ধরায় শতকোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পথ যে রুদ্ধ হয়েছে তা-ই নয়, দেশের মানুষও ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে।
বিশ্বায়ন ও আগ্রাসী বাজার অর্থনীতির কারণে যদি সর্বজনীন জাতীয় উৎসবের আনন্দ মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য এক (০.০০১) শতাংশ মানুষ উপভোগ করে, তখন তা আর জাতীয় উৎসব থাকে না। শ্রেণিনির্বিশেষের উৎসবে রূপ নেয়। সমাজের একটি শ্রেণির হাতে বৈধ-অবৈধ উপায়ে উপার্জিত বিপুল অর্থ সঞ্চিত হওয়ায় নববর্ষের উৎসবের চরিত্রটাই নষ্ট হয়ে গেছে। পোশাক ও জুতা-স্যান্ডেলের দোকানের বাহারি বিজ্ঞাপনে মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীর মনে রং ধরতেই পারে। পোশাক বেচাকেনায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু সব পোশাকই কি দেশি তাঁতের তৈরি? ভিনদেশি শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ বিক্রি হচ্ছে দেদার। নববর্ষের সঙ্গে নতুন কাপড়ের কী সম্পর্ক? নতুন কাপড়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভোগবাদের। শুধু ঈদ-পূজা-বুদ্ধপূর্ণিমাতে নয়, এখন ইংরেজি নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৪ ফেব্রুয়ারিতেও নতুন কাপড় পরার জন্য ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারি শোকের দিন। গত একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার ও বাংলা একাডেমিতে গিয়ে নতুন কাপড় পরার যে বাহার দেখেছি, তা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে তাজ্জব ও বিরক্ত হওয়ার ঘটনাগুলোর একটি। টিআইবি প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামানকে শুধু বললাম: হায়, এ কী দেখছি! শহীদ স্মৃতি অমর হোক না বলে ‘বাজার অর্থনীতি জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেওয়া উচিত ছিল।
বাংলা নববর্ষের আগে এখন স্বর্ণালংকারের দোকানে উপচে পড়া ভিড়। সুপার মার্কেটগুলোর বিদেশি পণ্যের দোকানেও। টাকার অভাব নেই। পত্রিকার খবর, ‘সম্ভাব্য লেনদেন প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা’। মিডিয়া আরও জানাচ্ছে, ‘অনলাইন কেনাকাটায় বৈশাখী ছাড়। কম মূল্যে হোম ডেলিভারির সুবিধা। টি-শার্ট, ঘড়ি, চশমা, বডি স্প্রে, বিউটি ও হেলথ, মেয়েদের শাড়ি, কুর্তি, টপ ও জুয়েলারি পণ্যে, ইলেকট্রনিক দ্রব্যে ৭ থেকে ৫০ শতাংশ মূল্য ছাড়।’ এক হালি ইলিশের দাম ৪০ হাজার টাকা। গ্রামের মৃৎশিল্পীর পণ্য, বাঁশ ও বেতশিল্পীর কাজ, বিন্নি ধানের খই, সাজ-বাতাসার ব্যবসায়ীদের কী হবে? নিজেকে গ্রাম্য ও রক্ষণশীল পরিচয় দিতে আমার লজ্জা নেই। বৈশাখী মেলায় ঘুরে কেনাকাটার যে আনন্দ ‘হোম ডেলিভারি’তে কি তার চেয়ে বেশি সুখ?
বাংলা নববর্ষে গ্রামবাংলার নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। বাংলার গেরস্থের উঠান তো নারীরই সাম্রাজ্য। উঠানে যে আলপনা আঁকা হতো, তা তো পুরুষের আঁকা নয়—নারীর। ওসব আলপনার একটি আবেদন ছিল। দেহাতি বাংলার গ্রামীণ সমাজে আজ গভীর হতাশা। চিরকালের বাংলা নববর্ষে জৌলুশ ছিল না, ছিল স্নিগ্ধ রুচির প্রকাশ। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য গ্রামবাংলার জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত জীবনরসের সঞ্জীবনী সুধা শুকিয়ে গেছে।
পাগলা ঘোড়ার মতো আমরা ছুটে চলেছি। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতি আমাদের তাড়া করছে। আমরা ধেয়ে চলেছি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে লক্ষ্যহীন গন্তব্যের দিকে। অথচ আমরা চেয়েছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানের বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব থেকে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে। তা করতে গিয়ে আমরা শুরু করি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। তা থেকেই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য স্বাধিকার আন্দোলন। স্বাধিকার সংগ্রাম থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। আজ যদি সেই জাতীয়তাবাদী চেতনা বিসর্জন দিয়ে পশ্চিমি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ করি তা আমাদের চরম দীনতা ও নৈতিক পরাজয়। আমাদের বিশ্বায়নের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন বাংলায়ন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.