নেতাদের ট্যানারির কাজই এগোয়নি by রাজীব আহমেদ ও শুভংকর কর্মকার

সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতে গুলশান ট্যানারি, কোহিনুর
ট্যানারি ও আঞ্জুমান ট্রেডার্সের প্লটে নির্মাণকাজের বর্তমান অবস্থা
একসঙ্গে পাঁচটি প্লট। মোট আয়তন ১ লাখ বর্গফুট। এক পাশে ৩০ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে ভবন তৈরি চলছে। এক তলার ছাদ ঢালাই হয়েছে। বাকি অংশে কয়েকটি রড-সিমেন্টের পিলার দাঁড়িয়ে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাঁশ ও রড। সামনের সাদা-কালো রঙের ছোট সাইনবোর্ড দেখে বোঝা গেল এটি গুলশান ট্যানারি, কোহিনুর ট্যানারি ও আঞ্জুমান ট্রেডিংয়ের জায়গা। ট্যানারি তিনটি একই পরিবারের। দেখভাল করেন শাহীন আহমেদ। তিনি কোহিনুর ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান। ট্যানারি ভবন নির্মাণকাজে বেশ পিছিয়েই আছেন এই নেতা। তবে বিসিকের তথ্য, সরকারের কাছ থেকে কোহিনুরের জন্য ৫৩ লাখ ৫২ হাজার, গুলশানের জন্য ৬২ লাখ ও আঞ্জুমানের জন্য ৭১ লাখসহ মোট ১ কোটি ৮৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ নিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান ও আনোয়ার ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলজাহান ভূঁইয়া। তাঁর প্লটে ট্যানারি ভবন নির্মাণের কাজ অনেক পিছিয়ে। পাইলিংয়ের কাজ শেষে বর্তমানে একতলার পিলারের নির্মাণ চলছে। চারপাশের সীমানা দেয়ালও পুরো শেষ হয়নি। সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি ভবন নির্মাণে এই দুজন শীর্ষ নেতার মতো দুই সংগঠন—বিটিএ ও বিএফএলএলএফইএর বেশ কয়েকজন নেতা পিছিয়ে আছেন। তাঁদের অগ্রগতি নিচতলার কলাম তৈরির মধ্যে আটকে আছে। ফলে ওই সব নেতার ট্যানারি শিগগিরই চামড়া শিল্পনগরীতে উৎপাদনে যেতে পারছে না। পাশাপাশি বড় প্লট পেয়েছে এমন কয়েকটি ট্যানারিও নির্মাণকাজ এগোতে পারেনি। সাভারের চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্প এলাকায় গত বুধবার চার ঘণ্টা ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। ট্যানারির মালিকদের দুটি সমিতি। বিটিএর সদস্য ১৪২টি ট্যানারি। আর বিএফএলএলএফইএর সদস্য ১০৬। এই দুই সমিতির সদস্যরাই মূলত সাভারের শিল্পনগরীতে প্লট পেয়েছেন। জানতে চাইলে চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবদুল কাইউম বলেন, সমিতির নেতারা যে অবকাঠামো নির্মাণে পিছিয়ে তা নিয়ে সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে কথা উঠেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে নেতারা চুপসে যান। তিনি বলেন, ‘যারা বড় প্লট নিলেও কাজ এগোচ্ছে না তাদের প্লট বাতিলের বিষয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমার কাছে ২৮টি আবেদন আছে, যারা শুধু প্লট চায়, ক্ষতিপূরণ নয়। কাজ না করলে প্লট বাতিল করে নতুন আবেদনকারীদের দেওয়া হবে।’ মেসার্স লেক্সকো লিমিডেটের প্লটের আয়তন ১ লাখ ৯০ হাজার বর্গফুট। বিশাল জমি নিয়ে ট্যানারিটি এক পাশে নিচতলার বিম তৈরি করেছে। আরেক পাশে গর্ত করে এখন মাটি ফুটিংয়ের কাজ করছে। ট্যানারিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুন-অর-রশিদ বিএফএলএলএফইএর সম্প্রতি বিদায় নেওয়া কমিটির নির্বাহী সদস্য। জানতে চাইলে হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্লটটি নদীর পাশে হওয়ায় পাইলিং করতে সময় বেশি লেগেছে। এক মাসের মধ্যে প্রথম তলার ছাদ ঢালাই করতে পারবেন তিনি। বেঙ্গল লেদার কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিপু সুলতান বিএফএলএলএফইএর নির্বাহী সদস্য। তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গফুটের বিশাল প্লট। তবে কাজ করেছেন সামান্যই। সাভারে তাঁর ট্যানারির প্রতিনিধি মো. ফিরোজ জানান, সেখানে মোট সাতটি ভবন হবে। এর মধ্যে তিনটির নিচতলার বিম তৈরি হয়েছে। বাকি চারটি ভবনের কাজ পরে শুরু হবে। মাটি কাটাসহ সব মিলিয়ে ছয় মাস ধরে কাজ চলছে। পিছিয়ে থাকা শাহজালাল লেদার কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহজালাল মজুমদার। তিনি বিএফএলএলএফইএর নির্বাহী সদস্য। তাঁর ট্যানারির অগ্রগতি নিচতলার বিম নির্মাণ পর্যন্ত। একই সমিতির আগের কমিটির নির্বাহী সদস্য আবুল কালাম আজাদের মালিকানাধীন কালাম ব্রাদার্স ট্যানারির প্লট বেশ বড়, কিন্তু ভবন নির্মাণের অগ্রগতিও নিচতলার বিম পর্যন্ত। নিচতলার কলাম তৈরি হচ্ছে হেলেনা এন্টারপ্রাইজেরও, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বিটিএর ভাইস চেয়ারম্যান। বিটিএর কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সমতা লেদার কমপ্লেক্সের নির্বাহী পরিচালক। তাঁর ট্যানারির নিচতলার ছাদ তৈরি করতে দেখা গেছে। বিটিএর উপদেষ্টা মনির হোসেনের মিরাজ লেদারের নিচতলার বিমের কাজ চলছে। নিজ পরিবারের তিন ট্যানারির কাজের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিএর সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, গত বছর বর্ষার কারণে তাঁরা কাজ এগোতে পারেননি। এখন পুরোদমে কাজ চলছে। আর বড় প্লট নিয়ে কাজ না করা মালিকদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টা বিসিক বুঝুক। তারাই সিদ্ধান্ত নিক কী করবে।’ বিএফএলএলএফইএর চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অর্থের সংস্থান না করতে পারায় অনেকে কাজ শুরু করতে দেরি করেছে। তাদের আমরা চাপের মধ্যে রেখেছি।’ ক্ষতিপূরণের শর্ত শিথিলের দাবি: ট্যানারি স্থানান্তরে মালিকদের সহায়তা করতে সরকার ২৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। শর্ত ছিল, নির্মাণকাজের অগ্রগতি বিবেচনা করে তিন ভাগে এ অর্থ দেওয়া হবে। সাভারে কাজ শুরু করলে ২০ শতাংশ, এক তলার ছাদ নির্মাণ করলে ৪০ শতাংশ ও পুরো স্থানান্তর শেষে বাকি ৪০ শতাংশ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত ১২৬টি ট্যানারি ২০ শতাংশ অর্থ পেয়েছে। ৪০ শতাংশ পেয়েছে ৩১টি ট্যানারি। সেই হিসেবে এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের প্রায় ৬০ কোটি টাকা পেয়েছেন ট্যানারির মালিকেরা। তবে নির্মাণকাজ না এগোনোয় ক্ষতিপূরণের দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তির টাকা পাচ্ছেন না মালিকেরা। এ জন্য সরকারের কাছে শর্ত শিথিল করে ক্ষতিপূরণের টাকা ছাড় করার দাবি করে বিএফএলএলএফইএ শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় ইতিবাচক বিবেচনায় আছে বলে জানালেন প্রকল্প পরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.