স্বাধীন ও মুক্তভাবে বাঁচা

রেবেকা গ্রিন্সপ্যান
১৯৯০ সালে প্রথম জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তারপর পৃথিবীর দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কোটি মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে আমাদের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কথা হচ্ছে, এসব অর্জন যতই চিত্তাকর্ষক হোক না কেন, তা সমানভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশে দেশে যেমন বৈষম্য রয়েছে, তেমনি একটি দেশের মধ্যেও সে পার্থক্য বিরাজমান। শিশুমৃত্যুর কথাই ভাবুন। আইসল্যান্ডে দেখা যায়, প্রতি ১ হাজার শিশুর মধ্যে দুটি শিশু প্রথম জন্মদিনের আগেই মারা যায়, অথচ মোজাম্বিকের ক্ষেত্রে সে সংখ্যাটা ১২০। একইভাবে বলিভিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিরক্ষর নারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুর এক বছরের মধ্যে মৃত্যুর হার মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুর চেয়ে বেশি। এই বৈষম্য একজন ব্যক্তিকে জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়। দেখা যায়, মধ্য আমেরিকার নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুর পাঁচ বছর বয়সের উচ্চতা উচ্চ আয়ের পরিবারে জন্ম নেওয়া একই বয়সের শিশুর চেয়ে ছয় সেন্টিমিটার কম। এই পার্থক্যগুলো নানা কারণেই সমাজে শিকড় গেড়ে বসছে। এর মধ্যে আছে ‘উল্লম্ব অসমতা’, যা ঠিক পক্ষপাতমূলক আয় বণ্টনের মতো। আবার তার সঙ্গে আছে ‘আনুভূমিক অসমতা’, যেটা সৃষ্টি হয় সাধারণত বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে। সমাজের মধ্যে বাসস্থানগত বিন্যাসের কারণেও এটা হয়ে থাকে। বহু মানুষই একসঙ্গে নানা রকম বৈষম্যের শিকার হয়, আর তাদের মধ্যে যে মাত্রায় আন্তযোগাযোগ হয়, সে মাত্রায়ই তারা বঞ্চিত হয়। এই উল্লম্ব ও আনুভূমিক অসমতার সম্মিলিত ফলাফল হিসেবে বঞ্চনার মাত্রা চূড়ান্ত জায়গায় যেতে পারে, যার কারণে বংশপরম্পরায় মানুষের দারিদ্র্য ও অসমতা চিরস্থায়ী রূপ নিতে পারে। সৌভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শান্তি, ন্যায় ও মানব উন্নয়নের ওপর এই অসমতার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে পৃথিবী ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠছে। এটাও পরিষ্কার হয়ে গেছে যে অসমতার কারণে সামাজিক বন্ধন আলগা হয়, আর সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা বাড়ে। শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক নীতি ও সামাজিক নীতি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অসমতা হ্রাসের নৈতিক যুক্তির পাশাপাশি একটি অর্থনৈতিক যুক্তিও রয়েছে। সেটা হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফল যদি সমাজে সমভাবে বণ্টিত না হয়, তাহলে সমাজ থেকে চরম দারিদ্র্য দূর করতে আরও বেশি হারের প্রবৃদ্ধি দরকার হবে। এই উচ্চ মাত্রার অসমতার সঙ্গে রাজনৈতিক অভিজাতদের ক্ষমতা দখলের সম্পর্ক আছে, যারা উদারনৈতিক সংস্কার বাধাগ্রস্ত করে নিজ স্বার্থ রক্ষা করে। অসমতা যে সামষ্টিক লক্ষ্য ও কল্যাণ অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা নয়, তা উন্নয়নের পথেও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা দূর করে। যেমন, এর ফলে করের হার কম হয় বা যত বেশি আয় তত বেশি কর—এই নীতি অনুসরণ করা সম্ভব হয় না, আর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতেও বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যায়।শুধু প্রবৃদ্ধি হলেই এটা নিশ্চিত করা যায় না যে মানুষ সমানভাবে সরকারি পণ্য ও উচ্চ মাত্রার সেবা পাবে, এর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিরও প্রয়োজন আছে। লাতিন আমেরিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসই এর সবচেয়ে উজ্জ্বল নজির, যেটি পৃথিবীর সবচেয়ে অসম অঞ্চল। নতুন শতকের প্রথম এক দশকে এই অঞ্চলের সামাজিক অর্জন উল্লেখ করার মতো। গতিশীল অর্থনীতি, দারিদ্র্য, অসমতা দূরীকরণে টেকসই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির কারণে এটি সম্ভব হয়েছে, যেখানে দারিদ্র্য ও অসমতাকে পরস্পর নির্ভরশীল ব্যাপার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এসব প্রচেষ্টার কারণে লাতিন আমেরিকাই এখন পৃথিবীর একমাত্র অঞ্চল, যেখানে একদিকে দারিদ্র্য ও অসমতা দূর হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। সেখানকার আট কোটির বেশি মানুষ মধ্যবিত্তের কাতারে উঠে এসেছে, ফলে এই প্রথমবারের মতো এ অঞ্চলের মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা দারিদ্র্যের হার ছাড়িয়েছে। তবে অনেকে আবার যুক্তি দিয়েছেন, অনুকূল বাহ্যিক পরিবেশের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে পণ্যের উচ্চ মূল্য, যেটা অর্থনীতির সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। যদিও বিশ্বব্যাংকের এলএসির ইকুইটি ল্যাব এটা নিশ্চিত করেছে যে লাতিন আমেরিকার এই প্রবৃদ্ধি সেখানকার সামাজিক উন্নয়নের একটি অংশ মাত্র, আর বাকিটা সম্ভব হয়েছে সামাজিক ব্যয়ের মাধ্যমে আয়ের পুনর্বণ্টনের কারণে।বস্তুত অর্থনীতির সম্প্রসারণের মূলে ছিল আসলে আনুক্রমিক নীতি: নতুন প্রজন্মের উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিয়েছেন, যাঁরা উচ্চ বেতন লাভের পাশাপাশি সামাজিক ব্যয়ের সুবিধা পাচ্ছেন। আর সেখানে যাঁদের আয় সবচেয়ে নিচের দিকে, তাঁদের আয়ই বেশি বেড়েছে।
তবে এ মুহূর্তে লাতিন আমেরিকার প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় তার এই অর্জনগুলো পরীক্ষার মুখে পড়ে গেছে। সরকারের রাজস্ব আয়ের খাত সংকুচিত হয়েছে, বেসরকারি খাতেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। দারিদ্র্য ও অসমতা দূর করার প্রচেষ্টা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, এমনকি তাদের কষ্টার্জিত অর্জনগুলোও ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি মানব উন্নয়নের গতি ধরে রাখতে এই অঞ্চলের নীতিপ্রণেতাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে অসমতার হার কমানোর গুরুত্বের কথা আছে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা ও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের মধ্যেও তা আছে। এত সব প্রচেষ্টার লক্ষ্য হচ্ছে পৃথিবীকে একটি ন্যায্য, শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও টেকসই স্থানে পরিণত করা। জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল ডিক্লেয়ারেশন অব হিউম্যান রাইটসে বলা হয়, ‘সব মানুষই অধিকার ও মর্যাদার দিক থেকে স্বাধীন ও মুক্ত’, তাহলে আমরা সবাই সেভাবে জীবন যাপন করতে পারব না কেন?
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
রেবেকা গ্রিন্সপ্যান: আইবেরো-আমেরিকানের মহাসচিব।

No comments

Powered by Blogger.