আওয়ামী লীগের ‘ন্যাপ নেতা’ মহিউদ্দীন আহমেদ by সোহরাব হাসান

মহিউদ্দীন আহমেদ
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের গোড়ার দিকের কথা। দৈনিক সংবাদ-এর প্রথম পাতায় একটি সচিত্র খবর ছাপা হলো। আজিমপুরের তৎকালীন হেলিও মিডল স্কুলে (স্বাধীনতার পর নাম হয় অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়) নিচের শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া দুই শিশু শিক্ষার্থী সাজ্জাদুল আলম ও রোজিনা আহমেদকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। মাত্র ১৭–১৮ দিন আগে তারা ভর্তি হয়েছিল। শিশুদ্বয়ের মা রেবেকা আহমেদ কারণ জানতে চাইলে স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ আমিনা রহমান হাস্যকর যুক্তি দেন যে স্কুলে বেঞ্চ নেই। রেবেকা বললেন, তিনি বেঞ্চ কিনে দেবেন। কিন্তু অধ্যক্ষ অনড়। আসল কারণ হলো, ওই শিশু দুটির বাবা মহিউদ্দীন আহমেদ তখন রাজবন্দী হয়ে কারাগারে। এ রকম একজন ‘দুর্ধর্ষ’ রাজবন্দীর সন্তানদের কীভাবে স্কুলে রাখবেন ‘রাজানুগত’ অধ্যক্ষা? আমিনা রহমান পরে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী হয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে অনেক বাম ও জাতীয়তাবাদী নেতার পরিবারকেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। অনেক বাড়িওয়ালা কারাবন্দী রাজনীতিকদের পরিবারকে ঘরভাড়াও দিতেন না। মহিউদ্দীন আহমেদের জন্ম ১৯২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি, পিরোজপুরে। এরপর তাঁদের পরিবার চলে যায় মঠবাড়িয়ার গুলিশাখালী। যদিও তাঁদের পৈতৃক বাড়ি ছিল গৌরনদীতে। পরিবারের পরিচয় দিতে গিয়ে মহিউদ্দীন আহমেদ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘বংশ পরিচয়ের দিক থেকে আমরা মাঝি। বংশ পরিচয়ের মধ্যে কোনো গৌরব-অগৌরবের ব্যাপার নেই।’ যে দেশে রাজনীতিকেরা নিজেদের কৌলীন্য বাড়াতে সৈয়দ, চৌধুরী, খান ইত্যাদি পদবি জুড়তে তৃপ্তিবোধ করেন, সে দেশের একজন রাজনীতিকের এই উক্তি ব্যতিক্রমীই বটে। মহিউদ্দীন আহমেদের রাজনীতির হাতেখড়ি গেল শতকের চল্লিশের দশকে, মুসলিম ছাত্রলীগের মাধ্যমে। মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে মুসলিম লীগ। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী মুসলিম লীগ নেতাদের গণবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক কাজকর্ম মেনে নিতে পারেননি। ১৯৫২ সালে গণতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রী দলের নেতা হিসেবে মহিউদ্দীন ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকিটে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন। এর আগেই অবশ্য সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে তাঁকে জেলে যেতে হয়। জেলখানাতেই আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। সেখানে তাঁরা একসঙ্গে অনশনও করেন। নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেলেও মহিউদ্দীন আহমেদ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনিই ১৯৫৭ সালের ১ ও ৩ এপ্রিল স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন। শেখ মুজিব, মোজাফ্ফর আহমদ, আসহাবউদ্দিন প্রমুখ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিলেও খোন্দকার মোশতাক মুসলিম লীগারদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘আপনারা কি একেবারে স্বাধীন হতে চান?’
১৯৫৭ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হলে গণতন্ত্রী পার্টি এর সঙ্গে একীভূত হয়। মহিউদ্দীন আহমেদ হন নতুন দলের যুগ্ম সম্পাদক। কিন্তু এক বছরের মাথায় আইয়ুব খান দেশে সামরিক শাসন জারি করলে অন্যান্য নেতার সঙ্গে তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়। একনাগাড়ে পৌনে পাঁচ বছর জেল খাটার পর মুক্তি পান মহিউদ্দীন আহমেদ। লেখার শুরুতে উল্লিখিত ঘটনাটি ওই সময়েরই। সে সময় পরিবারের দুরবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে মহিউদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, ‘আমি জেলে চলে আসার পরবর্তী ছয় মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে আদমজী ইনস্যুরেন্স ১৭০ টাকা করে মাসোহারা পাঠাত আমার স্ত্রী রেবেকার কাছে। কিন্তু তারপর বন্ধ করে দেওয়া হয় টাকা পাঠানো। আমি টেনশনে পড়লাম।’ গত ৯ এপ্রিল আলাপকালে সময়ের আরেকটি ঘটনা বললেন তাঁর স্ত্রী রেবেকা আহমেদ। মহিউদ্দীন জেলে যাওয়ার পর একজন বাঙালি পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর পিছু নেন। নানা প্রলোভন ও হুমকিতেও যখন কাজ হচ্ছে না, তখন তিনি পকেটে রাখা পিস্তল দেখিয়ে তাঁকে বলেন, ‘আপনি কথা না শুনলে মহিউদ্দীন আহমেদের অবস্থা খুব খারাপ হবে।’ কিন্তু রেবেকা তাঁর কথা আমলেই নেননি।
১৯৬৩ সালে জেলখানা থেকে বের হয়ে মহিউদ্দীন সারা পাকিস্তানে ন্যাপকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন। আইউববিরোধী আন্দোলনেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তখন পাকিস্তানের উভয় অংশেই ন্যাপের বেশ জনভিত্তি ছিল। আওয়ামী লীগ ছিল পূর্ব-পাকিস্তানভিত্তিক দল। তবে দুটি ঘটনা রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে দেয়। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি দিলে তার পক্ষে জনজোয়ার তৈরি হয়। অন্যদিকে মস্কো ও বেইজিং প্রশ্নে ভাগ হওয়ার পর ন্যাপ সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হতে থাকে। যদিও ছাত্র ইউনিয়ন তখনো বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন। ন্যাপ সম্পর্কে মহিউদ্দীনের আত্মসমালোচনা হলো: ‘এদিকে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় আন্দোলনের মূলধারা থেকে ন্যাপ (ওয়ালি) কিছুটা পিছু হটতে শুরু করেছে। এর প্রধান কারণ ন্যাপ ছিল পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের শোষিত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে। কিন্তু তখন আর পূর্ববঙ্গের মানুষ উভয় অঞ্চলের কথা শুনতে নারাজ।’
তাঁর আত্মজীবনীর নাম আমার জীবন আমার রাজনীতি। প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে, ২০০২ সালে। বইয়ে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনের চেয়ে বেশি উঠে এসেছে তাঁর সময়ের রাজনীতি, সমাজ ও মানুষ। তিনি নির্মোহ দৃষ্টিতে সবার সবলতা ও দুর্বলতা বিবৃত করেছেন। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ও দুর্দিনের সুহৃদ। রাজনৈতিকভাবে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও আমরা উভয়েই এ দেশের গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিয়োজিত। একের সঙ্গে অপরের একটা প্রাণের টান অনুভব করেছি সব সময়।’
বঙ্গবন্ধুর আগ্রহেই তিনি ১৯৭৩ সালে ন্যাপ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং দলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতির দায়িত্ব নেন। তবে এর পেছনে একটি ঘটনা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাজ করেছে বলে অনেকের ধারণা। বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন সিনেটর ও ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা এডওয়ার্ড কেনেডি ঢাকায় এলে বিমানবন্দরে অন্যদের সঙ্গে মহিউদ্দীন আহমেদও গিয়েছিলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আহমেদ সাজ্জাদুল আলম, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক, জানান, ‘এর মধ্যে কোনো রাজনীতি ছিল না। আমরা পীড়াপীড়ি করতেই বাবা আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন।’ কিন্তু তখন ন্যাপের ঘোষিত নীতি ছিল আমেরিকার সবকিছুই খারাপ।
মহিউদ্দীন আহমেদ দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। পঞ্চাশের দশকে তিনি পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভায় স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে প্রস্তাব পাস করিয়ে নিয়েছেন। ষাটের দশকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে জেল খেটেছেন। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক ট্র্যাজেডির পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যখন হতাশ ও বিচ্ছিন্ন, তখন তিনি তাঁদের একত্র করে দল সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা হন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর মস্কো সফর নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনা আছে। এ সম্পর্কে সাজ্জাদুল আলমকে জিজ্ঞেস করলে জানান, ‘বাবা কী পরিস্থিতিতে মস্কো যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু তিনি মস্কো থেকে ফিরে আসার পরই সরকার বাড়ি থেকে আমাদের উচ্ছেদ করে, যে বাড়িতে আমরা থাকতাম স্বাধীনতার আগে থেকে।’
১৯৮৩ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে মহিউদ্দীন আহমেদ জেল খেটেছেন। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তিন জোটের যে বৈঠকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নাম ঘোষণা করা হয়, সেই বৈঠকটি হয়েছিল তাঁর বাড়িতেই। নেতারা ভেতরে, বাড়ির আঙিনায় ছাত্র-তরুণেরা স্লোগান দিচ্ছিল ‘সিদ্ধান্ত না নিয়ে বের হতে পারবেন না।’ নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েই বের হয়েছিলেন।
আশির দশকের প্রথমার্ধে আওয়ামী লীগ থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে বাকশাল গঠন করলে তিনি তার সভাপতি হন, পরে আবার তাঁরা আওয়ামী লীগে ফিরেও আসেন।
মহিউদ্দীন আহমেদ ছিলেন গণমানুষের নেতা। স্বাধীনতার পর সরকারি দলে যোগ দিলেও মন্ত্রী হননি। দলকে সংগঠিত করেছেন। ১৯৫৪, ১৯৭৯, ১৯৯১-এ নির্বাচিত হয়েছেন বিরোধী দলে থেকে। কিন্তু তাঁর একটি আফসোস ছিল, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও তিনি জয়ী হতে পারেননি। সেই আসনে জাতীয় পার্টি থেকে এমন একজন নেতা জয়ী হন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশও তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। এই মনোবেদনা নিয়েই মহিউদ্দীন আহমেদ ১৯৯৭ সালের ১২ এপ্রিল মারা যান।
চার দশকের রাজনৈতিক জীবনের শেষ আড়াই দশক আওয়ামী লীগ-বাকশাল করলেও তিনি ন্যাপের মহিউদ্দীন হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। এই পরিচিতি প্রমাণ করে তিনি আজীবন বাম পন্থাকেই ধারণ করে ছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.