পালমিরার বিধ্বস্ত প্রান্তর ও ইতিহাসের হন্তারক by মনজুরুল হক

পালমিরার স্থাপত্য
মানব সভ্যতার ইতিহাস ঠিক কত সহস্র বর্ষের পথ পরিক্রমার ইতিহাস, তা নিয়ে হয়তো মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের বিবর্তনের ধারা যে শুধু শত কিংবা হাজার বছরের পথ চলার হিসাবের মধ্য দিয়ে বর্তমানের এই পর্যায়ে এসে পৌঁছায়নি, তা নিয়ে তর্ক–বিতর্ক অর্থহীন। ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান এবং সেই সঙ্গে নানা রকম বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আমাদের সহজেই বলে দিতে সক্ষম যে এই ধরণিতে প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল কয়েক লাখ বছর আগে এবং ঘাত-প্রতিঘাতের ধারাবাহিকতা ও পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের মধ্য দিয়েই কেবল সভ্যতার এখনকার এই পর্যায়ে আমরা পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি। রাষ্ট্র ও জাতীয়তার একালের এই বিভাজন খুবই সমকালীন। কিন্তু সেই সত্যকে মেনে নিলে এটাও আমাদের মানতে হবে যে অতীতের সেই ইতিহাস সার্বিকভাবেই হচ্ছে মানব সভ্যতার ইতিহাস, যে ইতিহাসের অংশীদার মানব সমাজের সদস্য হিসেবে আমরা সবাই। আর তাই আমাদের সেই অভিন্ন অতীতকে জানতে পারার জন্য ইতিহাসের সংরক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেই ইতিহাস লিখিত কোনো পাঠের রূপ নিয়ে কিংবা বস্তু বা স্থাপত্য নিদর্শনের আকারে অথবা অন্য যেকোনো আদলেই উপস্থিত হোক না কেন। আর এ কারণেই অতীতের সে রকম ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণের দায়িত্বও মানব সভ্যতার অংশীদার হিসেবে আমাদের সবার ওপর সমানভাবে বর্তায়। উল্টোভাবে আবার মানব সভ্যতার চলমান ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন যুগে এ রকম অনেক ঘটনার দেখা মেলে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় হঠাৎ বিলুপ্তি টেনে দেওয়ার অপপ্রয়াস যেখানে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, এটা হচ্ছে সেই রকম কীর্তিকলাপ, নির্ধারিত গণ্ডির বাইরে ইতিহাসের পদচারণ নেই, তা প্রমাণ করার জন্য অতীতের সব রকম নিদর্শন ধ্বংস করে দেওয়ায় হঠাৎ করে শক্তিশালী হয়ে ওঠা কোনো সমরনায়ক বা গোষ্ঠীকে যেখানে উন্মত্ত আচরণে লিপ্ত হতে দেখা যায়। তবে আমরা জানি সে রকম সংকীর্ণ লক্ষ্য সামনে রেখে ইতিহাসকে যারা শত্রু হিসেবে ধরে নেয়, ইতিহাসের ভ্রান্ত পাঠের দীক্ষা আমাদের দেওয়ার জন্যই সেটা তারা করে। ইতিহাসকে ধ্বংস করে দেওয়ার সে রকম চক্রান্তও অনেকটা যেন মানব সভ্যতার মতোই প্রাচীন। নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে জাহির করতে হলে আগের যা কিছু কীর্তি, সেগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলে নগ্ন প্রান্তরে আমার ভেঙে পড়া কুটির হয়ে উঠবে স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এবং আমার প্রচার করা শিক্ষাই তখন হবে শিক্ষার একমাত্র সঠিক দৃষ্টান্ত। ফলে ইতিহাসকে হত্যার প্রচেষ্টারও শুরু বলা যায় অনেকটা যেন মানব সভ্যতার আদি পর্ব থেকেই। তবে তারপরও ইতিহাস নিজে থেকেই মাথা তুলে দাঁড়ায় এবং এর দাম্ভিক হন্তারকদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে আমাদের জানিয়ে দেয় যে মানব জাতির কতটা নিকৃষ্টতম নিদর্শন হচ্ছে একসময়ের সেই সব একচ্ছত্র অধিপতি। চেঙ্গিস খান, হালাকু খান আর নাদির শাহের মতো ইতিহাসের অতীতের হন্তারক কিংবা এডলফ হিটলারের মতো যুগের ইতিহাস বধে প্রত্যয়ী খলনায়কদের আমরা কিন্তু খলনায়ক হিসেবেই দেখছি, অন্য কোনো অনুকরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে নয়। ফলে ইতিহাসের দিকে খড়্গহস্ত হলে নিজেকেই সেখানে হতে হয় পর্যুদস্ত, সেই শিক্ষা কিন্তু ইতিহাসই আমাদের দিচ্ছে। তবে তারপরও থেমে নেই বিশ্বজুড়ে ইতিহাস বধের তৎপরতা, যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত আমরা এখন দেখছি পালমিরার ধ্বংসযজ্ঞের দিকে দৃষ্টিপাত করে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে সাম্প্রতিক সময়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হন্তারক হিসেবে যাদের দেখা গেছে, তারা হলো মৌলবাদী ইসলামের দীক্ষায় দীক্ষিত জঙ্গির দল। পালমিরার ইতিহাস ধ্বংসের তৎপরতায় মাত্র কিছুদিন আগে যেভাবে এরা নিয়োজিত হয়েছিল, সেই একই খেলায় এদের জড়িত হতে দেখা গেছে আফগানিস্তানে প্রায় দুই হাজার বছরের প্রাচীন বামিয়ানের বিশাল সব বুদ্ধমূর্তি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার তৎপরতার মধ্যে। একইভাবে ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল মৌলবাদী জঙ্গিদের দখলাধীনে চলে আসার পর সেখানেও দেখা গেছে অতীতকে ধ্বংস করে দেওয়ার সেই একই খেলায় এদের লিপ্ত হতে। মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মূল্যবান সব নিদর্শন কুঠারের আঘাতে গুঁড়িয়ে দিয়েই এরা বসে থাকেনি, তাদের সেই ‘মহান’ কীর্তি বিশ্বের সামনে তুলে ধরার বাসনায় সেই অপকর্মের ভিডিও ছবিও একই সঙ্গে এরা প্রচার করেছে। অবাক হয়ে ভাবতে হয়, ইসলামের কোন শিক্ষা এদের অনুপ্রাণিত করছে মানব সভ্যতার তাবৎ ইতিহাসকে মুছে দিয়ে একেবারে সাদা পাতায় নতুন এক ইতিহাস রচনার সূচনা করতে? সন্দেহ নেই, সেই শিক্ষা হচ্ছে বিভ্রান্তির শিক্ষা, ইসলামের মূল আদর্শের সঙ্গে যার নেই কোনো রকম সম্পর্ক। বিভ্রান্তির সেই শিক্ষা যে দীক্ষা এদের দিচ্ছে তা হলো, অতীতকে মুছে দিতে পারলে এটা প্রমাণ করা আরও সহজ হবে যে এদের অনুসৃত বিভ্রান্তির ইসলামই হচ্ছে একমাত্র ধর্ম, যা কিনা সভ্যতার যাত্রাপথে মানুষকে দেখিয়ে দিতে পেরেছে শ্রেষ্ঠত্বের পথে পা বাড়ানোর সঠিক পথ। একই সেই ভ্রান্ত শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে মাঠে নেমেছে আমাদের দেশের মৌলবাদীরাও। যারা একইভাবে কেবল স্থাপত্য ধ্বংস করা কিংবা নাম মুছে ফেলার মধ্য দিয়েই নয়, সেই সঙ্গে অতীতকে আমাদের সামনে তুলে ধরার ব্রত নিয়ে শিক্ষা, গবেষণা ও সৃজনশীলতার অন্যান্য শাখার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, সে রকম অগ্রসর চিন্তার মানুষদের হত্যা করেছে। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের ধারাকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করায় ব্রতী হয়েছে। সে রকম উদ্দেশ্য নিয়েই ১৯৭১ সালে এরা নির্দ্বিধায় খুন করতে পেরেছিল দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, আর সেই হন্তারক তৎপরতার মধ্য দিয়ে মুছে দিতে উদ্যত হয়েছিল আমাদের অতীতের গৌরবময় অধ্যায়কে। এর সবটাই কিন্তু এরাও করেছিল ইসলামের দোহাই দিয়ে, ঠিক যেমনটা দেখা গেছে পালমিরার সভ্যতার নিদর্শন ধুলোয় গুঁড়িয়ে দেওয়ায় লিপ্ত হন্তারকদের বেলায়। পালমিরায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে একদিকে যেমন এরা সে রকম প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছিল যে ইসলামের আবির্ভাবের বাইরের যে অতীতের কথা বলা হয়, সে রকম অতীত বলতে কিছু নেই। অন্যদিকে নৃশংস আচরণের মধ্য দিয়ে ভয় দেখিয়ে মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখাও ছিল এদের আরও একটি উদ্দেশ্য। আমরা জানি, পালমিরার ধ্বংসাবশেষকে একই সঙ্গে এরা পরিণত করেছিল বধ্যভূমিতে, যেখানে শত্রুপক্ষের বন্দীদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে শিরশ্ছেদ করার ছবিও এরা বিশ্বজুড়ে প্রচার করে বেড়ায়। বছরাধিক কাল ধরে জঙ্গিদের দখলাধীন থাকার পর বন্দী পালমিরা এখন শত্রুমুক্ত। এ যেন হচ্ছে ইতিহাসকে অন্ধকূপ বন্দিশালা থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসা। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর এখনো যে প্রান্তরের এখানে-সেখানে ভগ্নদশা নিয়ে দাঁড়িয়ে দূর অতীতে মানুষের হাতে তৈরি মন্দিরের প্রবেশ পথ, উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চের ধুলায় মিশে যাওয়া ভিত কিংবা প্রাচীন অন্য কোনো স্থাপনার স্মৃতি বহন করা প্রস্তর স্তম্ভ। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২০০০ বছর আগে যে সভ্যতার সূচনা পালমিরায় হয়েছিল এবং সময়ের বিবর্তনে খ্রিষ্টাব্দের প্রথম শতকে এসে বর্ধিষ্ণু যে জনপদ সেখানে গড়ে উঠেছিল তার সঙ্গে ইসলামের কোনো বিরোধ নেই। ইসলামের গৌরবময় সময়ের শাসকেরাই এর প্রমাণ রেখে গেছেন। আরব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে ইসলাম ধর্মের প্রসারের মধ্য দিয়ে পালমিরাও একসময় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জনবসতি হয়ে উঠেছিল। সে যুগের ইসলামি শাসকেরা কিন্তু অতীতের রোমান নিদর্শন সংরক্ষণ করায় দেখাননি কোনো রকম কার্পণ্য। তবে কেন একালের ওহাবি দীক্ষায় অনুপ্রাণিত মৌলবাদী জঙ্গিরা অতীতকে শত্রু বলে ধরে নিচ্ছে? শিক্ষার সংকীর্ণতাই মনে হয় বড় ভূমিকা এখানে পালন করছে। বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি একে অন্যের কাছাকাছি আমাদের নিয়ে এলেও আধুনিক সভ্যতার বিভাজনমূলক এই বিশ্বে দেখা দিয়েছে আত্মপরিচয়ের সংকট। অন্যদিকে আবার আমাদের মধ্যে তৈরি করে দিচ্ছে এমন এক দেয়াল, যা কিনা ক্রমেই বিচ্ছিন্ন এক গণ্ডির ভেতরে আমাদের আবদ্ধ করে রাখছে।
অবহেলিত আর বঞ্চিত সেই গণ্ডিতে অতীত সাফল্যের জাবর কেটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা তুলছি তৃপ্তির ঢেকুর। এ কারণেই অতীতকে যে সেখানে করে তুলতে হয় প্রতিদ্বন্দ্বীমুক্ত। অর্থাৎ আমার অতীতই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম অতীত, এর বাইরে কিছু নেই। ফলে সেই গণ্ডির বাইরের যা কিছু নিদর্শন, গুঁড়িয়ে ফেল তার সবটা, মুছে দাও এর অস্তিত্ব। ধ্বংসের সে রকম এক খেলাই খেলে চলেছে মৌলবাদী জঙ্গিরা। তবে আমরা জানি সেই খেলায় পরাজয় এদের নিশ্চিত। পালমিরার এখনো দণ্ডায়মান অতীত সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ সেই সত্যকেই যেন আবারও আমাদের সামনে তুলে ধরছে।
(টোকিও, ৬ এপ্রিল ২০১৬)
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.