লড়াকু জীবনগাথায় সাহিত্যের নোবেল সোয়েতলানার

সাহিত্যে এ বছর নোবেল পুরস্কার জিতেছেন বেলারুশের লেখক ও অনুসন্ধানী নারী সাংবাদিক সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ।
মূলত সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখালেখির জন্য তিনি এ পুরস্কার জেতেন। সুইডিশ একাডেমির পক্ষ থেকে বলা হয়, তার লেখনী মানবজীবনের দুঃখ-কষ্ট আর সাহসীকতার এক অনন্য যুগলবন্দি; এ বিষয়ে বহুমাত্রিক লেখার জন্য তিনি এ সম্মানজনক পুরস্কার জিতেছেন।
বৃহস্পতিবার সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ১১২তম লেখক হিসেবে সোয়েতলানার নাম ঘোষণা করে সুইডিশ একাডেমি। ৬৬ বছর বয়সী সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ গত বছরও এ পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিলেন। তিনি হলেন চতুর্দশ নারী, যিনি সাহিত্যে নোবেল পেলেন। আগামী ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমে আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে পুরস্কার বাবদ তুলে দেয়া হবে ৮০ লাখ ক্রোনার।
চেরনোবিল বিপর্যয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ নিয়ে লেখা বইয়ের মাধ্যমেই সোয়েতলানা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেকে মেলে ধরতে সমর্থ হন। তিনি হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুর সাক্ষাৎকার নিয়ে তার বইয়ে ওই সব ঘটনাকে মর্মস্পর্শী করে তুলে ধরেন।
সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচের বিখ্যাত দুটি বই- ‘ওয়ার আনওমেনলি ফেস’ ও ‘জিংকি বয়’। সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রামাণ্য প্রতিবেদনের এই দুই বইয়ে তিনি সোভিয়েত আমল ও সোভিয়েত-পরবর্তী যুদ্ধবিগ্রহ ও মানবজীবনের সংকটকালীন নানা দিক তুলে ধরেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার বই দুটি অনূদিত হয়। এর মধ্যে প্রথম বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। প্রকাশের পর বইটি প্রায় দুই মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়।
সুইডিশ একাডেমি বলেছে, সোয়েতলানা তার অসাধারণ পদ্ধতিতে মানুষের কণ্ঠকে তার লেখনীতে মেলে ধরেছেন। যেন এটি একটি সম্পূর্ণ যুগের স্মৃতিস্তম্ভ। একাডেমির সচিব সারা দানিউস সোয়েতলানার প্রশংসা করে বলেন, তিনি একজন অসাধারণ লেখক। তিনি আমাদের কাছে একটা আবেগঘন ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচের জন্ম ১৯৪৮ সালে ইউক্রেনে। তার মা ছিলেন ইউক্রেনীয় বাবা ছিলেন বেলারুশীয়। তিনি বেড়ে উঠেন বেলারুশেই। সেখানে স্কুল পেরুবার পরই বিভিন্ন পত্রিকায় রিপোর্টিংয়ের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ক্রমেই নিজেকে একজন অনুসন্ধানী নারী সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তী সময়ে সাক্ষাৎকারভিত্তিক বই লিখে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। অর্জন করেন ব্যাপক জনপ্রিয়তা। ওই দুটি ছাড়াও তার প্রকাশিত বিভিন্ন বই রাজনীতি ও সাহিত্যের ওপর তার ব্যাপক দক্ষতা প্রমাণ করে।
১৯৭০ সালে স্থানীয় একটি পত্রিকায় রিপোর্টিংয়ের কাজ করার সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া বেশ কয়েকজন নারী সৈনিকের সাক্ষাৎকার নেন তিনি। এর ওপর রাশিয়ান ভাষায় লেখা তার ‘ওয়ার আনওমেনলি ফেস’ বইটি নিজ দেশেই প্রকাশিত হতে দেননি স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। বইটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বলা হয়, এতে শুধু ব্যক্তিগত ট্রাজেডিই স্থান পেয়েছে। বইটিতে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকার ওপর জোর দেয়া হয়নি।
সোয়েতলানার ‘জিংকি বয়’ বইটিতে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের চিত্র ফুটে উঠেছে। বইটিতে ওই হতভাগা মায়েদের মর্মস্পর্শী কথা তুলে ধরেন তিনি যারা ওই সময় তাদের সন্তানকে হারিয়েছেন। ১৯৯৮ সালে তার ‘ভয়েজ ফ্রম চেরনোবিল’ বা ‘চেরনোবিলের আওয়াজ’ বইটি প্রকাশিত হয়। এতে তিনি ১৯৮৬ সালে পারমাণবিক বিপর্যয়ে ভয়ংকর পরিণতির শিকার মানুষের কথা তুলে ধরেন।
গত বছর সাহিত্যে নোবেল পান ফরাসি ঔপন্যাসিক প্যাত্রিক মোদিয়ানো, যার গল্পে উঠে আসে মানবমনের স্মৃতি-বিস্মৃতির খেলা, আত্মপরিচয়ের সংকট আর প্যারিসে নাৎসি দখলদারিত্বের ইতিহাস।
সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের শেষ ইচ্ছা অনুসারে গবেষণা, উদ্ভাবন ও মানবতার কল্যাণে অবদানের জন্য প্রতিবছর চিকিৎসা, পদার্থ, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। আজ শান্তি এবং আগামী সোমবার অর্থনীতিতে এবারের নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.