শুনেছেন, লিখেছেন, জিতেছেন নোবেল

মিনস্কে সংবাদ সম্মেলনস্থলে এসে পৌঁছালে
ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয় স্ফেতলানা
আলেক্‌সিয়েভিচকেl ছবি: রয়টার্স
তিনি নিজ কানে শুনেছেন প্রত্যক্ষদর্শীর কথা, ভুক্তভোগীর কথা। লিখেছেন সে কথাগুলোই। সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যচর্চার নতুন ধারা। আর এভাবেই জিতে নিলেন নোবেল।
এ বছর সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার পেলেন বেলারুশের লেখক স্ফেতলানা আলেক্সিয়েভিচ। গতকাল বৃহস্পতিবার ৬৭ বছর বয়সী এই লেখককে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সুইডিশ একাডেমি। তাঁর সম্পর্কে একাডেমির সচিব সারা দানিউসের ভাষ্য, ‘বইয়ের তাক থেকে আপনি যদি তাঁর (আলেক্সিয়েভিচ) বইগুলো সরিয়ে ফেলেন, তাহলে দেখবেন সেখানে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় তিনি কতটা মৌলিক।’
আলেক্সিয়েভিচের জন্ম ১৯৪৮ সালে ইউক্রেনে। বাবা বেলারুশের, মা ইউক্রেনের। তাঁর বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা বেলারুশে। স্কুলের পাঠ শেষ করে স্থানীয় একটি পত্রিকায় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে সাংবাদিকতার ডিগ্রি নেন মিন্স্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
১৯৭০-এর দশকে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া নারীদের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করেন আলেক্সিয়েভিচ। এর ভিত্তিতেই প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে লেখেন দ্য আনওমেনলি ফেস অব দ্য ওয়ার। লেখা শেষ হয় ১৯৮৩ সালে। কিন্তু বাধা আসে বইটি প্রকাশে। অভিযোগ, এতে রুশ নারী যোদ্ধাদের বীরত্বকে অবমাননা করা হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাও ঠিকঠাক প্রতিফলিত হয়নি। অবশেষে মিখাইল গর্বাচেভের পেরেসত্রোইকা সংস্কারের পর ১৯৮৫ সালে বইটি আলোর মুখ দেখে।
আলেক্সিয়েভিচের দ্বিতীয় বই দ্য লাস্ট উইটনেসেস: দ্য বুক অব আনচাইল্ডলাইক স্টোরিস। শিশুর চোখে যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে লেখা বইটিতে আছে তাদের বক্তব্য, যাদের বয়স যুদ্ধের সময় ছিল ৭ থেকে ১২ বছর।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনে ছেলেহারা মায়েদের কষ্টগাথা নিয়ে আলেক্সিয়েভিচের তৃতীয় বই জিঙ্কি বয়েজ।
ইউক্রেনের ভয়াবহ চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৮৬ সালে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেলারুশ। সেখানে দূষণমুক্ত করার দুরূহ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যাঁরা নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের বয়ানে আলেক্সিয়েভিচ লিখেছেন দ্য চেরনোবিল প্রেয়ার: ক্রনিকল অব দ্য ফিউচার।
নিজের লেখার ধরন সম্পর্কে আলেক্সিয়েভিচের ব্যাখ্যা, ‘কোনো ঘটনা যখন ঘটে, তখন মানুষ কী বোঝে, কী ভাবে, কোনটা বিশ্বাস করে আর কোনাটা অবিশ্বাস করে, কল্পনায় কী থাকে, প্রত্যাশা ও আতঙ্কের অভিজ্ঞতাই বা কী—এসব ঠিকঠাক কল্পনা করে নেওয়া সত্যিই অসম্ভব।’
২০০৫ সলে যুক্তরাষ্ট্রে পেন ওয়ার্ল্ড ভয়েসেস ফেস্টিভ্যালে আলেক্সিয়েভিচ বলেছিলেন, ‘সবকিছু ঠিকঠাক তুলে ধরার পন্থা হাতড়ে বেড়াতে বেড়াতে আমার মনে হলো, যা ঘটে চলেছে তার সবচেয়ে কার্যকর বয়ান পাওয়া যাবে রাস্তাঘাটে বা জনসমাগমে মানুষ যা বলছে তা থেকেই। বই-পত্তর পড়ে বা মানুষ লেখনীর মাধ্যমে যা তুলে ধরার চেষ্টা করছে, তা থেকে আমি আসল জিনিস পাব না। কেউ যখন কিছু বলছে, তখন তা শোনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি সব সময় তাদের কথা শুনতে চেয়েছি।’
আলেক্সিয়েভিচের সাহিত্যকর্মকে ‘আমাদের কালের দুঃখবেদনা ও সাহসিকতার স্মারক’ বলে অভিহিত করেছে সুইডিশ একাডেমি। সাহিত্যে নোবেল দেওয়ার দায়িত্ব এই একাডেমির।
একের পর এক স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে লিখে যাওয়ায় আলেক্সিয়েভিচকে বিপত্তি পোহাতে হয়েছে বিস্তর। বই বের হচ্ছে, বিশ্বের মানুষ তাঁকে চিনছে-জানছে। কিন্তু নিজের দেশ বেলারুশে আজ পর্যন্ত ছাপা হয়নি তাঁর বই। সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের সমালোচনা করে যাওয়ায় তাঁকে দেশের বাইরেও থাকতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। লেখক বৃত্তি নিয়ে থেকেছেন ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স ও সুইডেনে।
আলেক্সিয়েভিচের সর্বশেষ বই সেকেন্ড-হ্যান্ড টাইম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা ‘সোভিয়েত মানসিকতার জের’ নিয়ে লেখা তাঁর এ বই ২০১৩ সালে জিতেছে ফ্রান্সের মর্যাদাশীল পুরস্কার ‘প্রি মেদিসিস এসে’।
দ্য চেরনোবিল প্রেয়ার: ক্রনিকল অব দ্য ফিউচার বইয়ের জন্য ২০০৫ সালে ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড, ২০১৩ সালে পিস প্রাইজ অব দ্য জার্মান বুক ট্রেডসহ গত প্রায় দুই দশকে আলেক্সিয়েভিচ বিভিন্ন দেশ থেকে পেয়েছেন আরও অন্তত ১০টি মর্যাদাশীল পুরস্কার।
ত্রয়োদশ নারী হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পেলেন আলেক্সিয়েভিচ। পুরস্কারটি তিনি উৎসর্গ করেছেন নিজ মাতৃভূমিকে। বেলারুশের রাজধানী মিন্স্কে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এটা শুধু আমার পুরস্কার নয়, এ পুরস্কার আমাদের সংস্কৃতির, আমাদের ছোট্ট দেশের, যারা ঐতিহাসিকভাবে নিষ্পেষিত হয়েছে।’
সাহিত্যসহ চিকিৎসা, রসায়ন ও পদার্থে এ বছর নোবেল ঘোষণা করা হয়ে গেছে। শান্তিতে নোবেল কে পাচ্ছেন, তা জানা যাবে আজ শুক্রবার। সব শেষে ১২ অক্টোবর ঘোষণা করা হবে অর্থনীতির নোবেল।
সুইডিশ বিজ্ঞানী ও মানবতাবাদী আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম ও নরওয়ের অসলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে নোবেল পদক ও পুরস্কারের অর্থ। বিজয়ীরা পাবেন ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার ( প্রায় ৯ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার)।
তথ্যসূত্র: এএফপি ও রয়টার্স।

No comments

Powered by Blogger.