চেতনানাশক ছাড়াই চেতনানাশের দেশে by আনিসুল হক

বাংলাদেশ লাতিন আমেরিকার মতো জাদুবাস্তবতার দেশ হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং তাঁর মতো লেখকদের লেখায়। যেমন, গার্সিয়া মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর উপন্যাসে কত বিস্ময়কর ঘটনাই না ঘটে। মাকান্দো নামের জনপদটিতে হঠাৎ অনিদ্রা দেখা দিল। ওই জনপদের প্রতিষ্ঠাতা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বলেন, ‘কখনো আর যদি না ঘুম আসে তো খুবই ভালো হয়। জীবনের কাছ থেকে আরও অনেক কিছু পাওয়া যাবে।’ কিন্তু তাতে যেটা হলো, ওই জনপদের সবাই ঘুম হারানোর সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিও হারিয়ে ফেলতে লাগল। সবকিছুর নাম ও ব্যবহার তারা ভুলে যাচ্ছে। তা ঠেকাতে তারা জিনিসপাতির গায়ে নাম ও সেসবের ব্যবহার লিখে রাখতে শুরু করল। যেমন, গরুর গায়ে তারা লিখে রাখল, ‘এটা হলো গরু। যাতে সে দুধ উৎপাদন করতে পারে, সে জন্য রোজ সকালে তাকে অবশ্যই দোহাতে হবে। আর সেই দুধ অবশ্যই জ্বাল দিতে হবে, যাতে করে কফির সঙ্গে মিশিয়ে কফি ও দুধ বানানো যায়।’
আমাদের দেশেও এই রকম উদ্ভট ঘটনা চলেছে। আমরাও চলেছি স্মৃতিহীনতার মধ্য দিয়ে। আমরা সবকিছু ভুলে যাচ্ছি। আমাদেরও লিখে রাখা উচিত, এটা হচ্ছে ট্রাফিক বাতি। এটা লাল হলে সব গাড়ি থামবে, সবুজ হলে সব বাতি চলতে শুরু করবে। এটা হলো সংবিধান। দেশে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, সবকিছু চলবে এই বই অনুসারে।
মার্কেসের একটা বিখ্যাত গল্প আছে—‘আমি শুধু টেলিফোনটি ব্যবহার করতে এসেছিলাম’। বাংলাদেশে গোটা তিনেক টিভি নাটক হয়েছে এই গল্প অবলম্বনে। ওই গল্পে দেখা যায়, একজন ভদ্রমহিলা একটা টেলিফোন করতে বেরিয়েছেন। টেলিফোন সেরে তিনি বাসের জন্য রাস্তায় দাঁড়ান। একটা বাস এসে তাঁর পাশে থামে। তিনি বাসে উঠে পড়েন। বাসটি ছিল মানসিক রোগিণীদের বহনকারী একটা যান। একটা হাসপাতাল থেকে রোগিণীদের নিয়ে তা আরেকটা হাসপাতালে যাচ্ছিল। ওই মহিলাকেও তারা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়। ভদ্রমহিলা বারবার করে বলছিলেন, আমি শুধু টেলিফোনটা ব্যবহার করতে এসেছিলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। অনেক কষ্টে, একজন ম্যাট্রনের অবৈধ প্রস্তাবে রাজি হওয়ার মাধ্যমে তিনি নিজের স্বামীকে ফোন করার সুযোগ পান। স্বামীকে জানান, তিনি আছেন অমুক মানসিক চিকিৎসালয়ে। স্বামী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এসে খোঁজখবর নেন। তারপর বলেন, ওরা বলছে, তোমার সুস্থ হতে আরও সময় লাগবে। তুমি থাকো, আমি আসি...
গল্পটা আমি স্মৃতি থেকে লিখছি। একটু উনিশ-বিশ হতে পারে।
বাংলাদেশও যেন মার্কেসের গল্পের পটভূমি হয়ে গেছে। যত দূর জানা গেল, মেঘালয়ের পুলিশ একজন বাংলাদেশিকে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় ঘোরাফেরা করতে দেখে। তারা তাঁকে পরিচয় জিজ্ঞেস করে। তিনি জানান, তিনি বাংলাদেশের মন্ত্রী ছিলেন।
সব পাগলই নিজেকে মন্ত্রী দাবি করে থাকে, সব মন্ত্রী যদিও নিজেকে পাগল দাবি করবেন না।
নিশ্চয়ই মেঘালয়ের পুলিশ হেসেছিল।
তারপর? মন্ত্রী ছাড়া আর কী পরিচয় আছে আপনার?
আমি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব। আমাদের কিন্তু কোনো মহাসচিব নেই, আমরা চলিই ভারপ্রাপ্ত দিয়ে।
বটে। ওকে একটা মানসিক চিকিৎসালয়ে নাও।
ভাগ্য ভালো, মেঘালয়ের ওই হাসপাতাল তাঁকে ফোন করার সুযোগ দিয়েছিল। আর ভাগ্যিস, সালাহ উদ্দিন আহমদের নিজের বাড়ির ফোন নম্বর মুখস্থ ছিল। আমি হলে, হাতে মোবাইল ফোন না থাকলে কোনো নম্বরই মুখস্থ বলতে পারতাম না।
ভাববেন না, আমি রসিকতা করছি। লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতার জগৎ কেবল আশ্চর্য সব ঘটনার জগৎ নয়, সে জগৎ বড় নিষ্ঠুরও। মার্কেসের একশ বছরের নিঃসঙ্গতা বইয়েই রেমেদিওস নামের এক সুন্দরী আকাশে উড়ে যায়। একজন দেখতে পায়, সে আকাশে উড়ে গেল, আর কোনো দিনও ফিরে এল না। তারও চেয়েও বড় ঘটনা, প্রতি ১৭ জন আরলিয়ানোর ১৬ জনই খুন হতে থাকে।
মার্কেসের বইয়ে আমরা পাই, কলাশ্রমিকেরা ধর্মঘটে গেলে পুলিশ গুলি করে, আর কলাবহনকারী ট্রেনে কলার বদলে বোঝাই করা হয় মানুষের লাশ!
লাতিন আমেরিকায় খুব গুম হয়, খুন হয়। মার্কেসের একটা সত্য ঘটনার বই আছে—নিউজ অব আ কিডন্যাপিং।
মার্কেস অবশ্য বলেন, যাকে বলা হয় ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা, তা তাদের মহাদেশের বাস্তবতা থেকেই ঘটে। যেমন: একটা এলাকায় এত বেশি সোনা ছিল যে মুরগির পেট কাটলে সোনার খুদ পাওয়া যেত, সেই দেশে যখন রেললাইন বানানোর প্রস্তাব করা হলো, তখন স্থানীয়রা বলল, লোহা দিয়ে রেললাইন বানালে খরচ বেশি পড়বে, সোনা দিয়ে কি রেললাইন বানানো যায় না?
আমাদের দেশের বাস্তবতাও এখন জাদুবাস্তবতা হয়ে উঠছে। এখানে নদীতে জাল ফেললে মাছের বদলে উঠে আসে মানুষের লাশ। এখানে প্রতি মাসে একজন করে ব্লগার খুন হচ্ছেন। আবারও মার্কেসের গল্প এসে যায়। তাঁর একটা বই আছে—পূর্বঘোষিত মৃত্যুর দিনপঞ্জি। একটা জনপদের সবাই জানে, সান্তিয়াগো নাসারকে খুন করা হবে, যারা খুন করবে, তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে বেড়াচ্ছে তারা সান্তিয়াগোকে খুন করার জন্য খুঁজছে, একেবারে পূর্বঘোষিত খুন, কিন্তু কেউ ব্যাপারটায় গা করে না, এবং সান্তিয়াগোকে পেটে ছুরি চালিয়ে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে একের পর এক পূর্বঘোষিত মৃত্যু ঘটানো হচ্ছে, এত মৃত্যুর বিবরণ লেখার মতো লেখকও তো আর অবশিষ্ট থাকছে না।
মার্কেসের লেখার একটা প্রধান উপজীব্য একনায়কদের নিঃসঙ্গতা। তাঁর একটা গল্পে পড়েছি, একজন ক্ষমতাচ্যুত জেনারেল, যিনি দেশের সর্বেসর্বা ছিলেন, ইউরোপের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন কপর্দকহীন মুসাফিরের মতো। আমাদের দেশেও এ রকমটা ঘটছে। আমাদের একনায়কেরাও বড়ই নিঃসঙ্গ, একনায়কেরা নিঃসঙ্গই হয়ে থাকেন, কিন্তু তাঁদের নিঃসঙ্গতার কাহিনি লেখার মতো কলমই বা রইল কই।
আমাদের দেশে জাদুবাস্তবতা সাহিত্যে আসেনি তা নয়। পুতুলনাচের ইতিকথায় একজন নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করার জন্য তাঁর মৃত্যুর তারিখ ঘোষণা করেন এবং ওই দিনই তিনি মারা যান। জাদুবাস্তবতা শব্দটা জানার আগেই আমাদের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখাতেও আমরা জাদুবাস্তবতার মতো ঘটনা ঘটতে দেখি।
এবং অবশ্যই স্মর্তব্য সৈয়দ শামসুল হকের অনবদ্য সৃষ্টি ‘পরানের গহীন ভিতর’ নামের কবিতাগুলো। এই বইয়ের প্রথম কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘এ বড় দারুণ বাজি তারে কই বড় বাজিকর/ যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।’ এই কবিতায় কবি বর্ণনা দিয়েছেন, কীভাবে জাদুকর জামার ভেতর থেকে জাদুমন্ত্রে ডাহুক বের করে, জ্যাবের ভেতর থেকে বের করে আকবর বাদশার মোহর।
কিন্তু ভোটারবিহীন স্বচ্ছ ভোট বাক্সে কী করে চমৎকার ভারসাম্য বজায় রেখে ব্যালট ভরে যায়, সেটা কি বলা যায়? এ বড় দারুণ বাজি তারে কই বড় বাজিকর—এই পঙ্ক্তি যিনি লিখতে পারতেন, তিনি কই?
মার্কেসের ‘ওয়ান অব দিজ ডেজ’ গল্পটা আমি চতুর্থবারের মতো আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিই। শহরের মেয়র গেছেন দাঁতের ডাক্তারের কাছে। পোকায় খাওয়া দাঁত তুলতে। ডাক্তার তাঁর দাঁত তুললেন কোনো রকমের চেতনানাশক ছাড়াই।
মেয়র অতিকষ্টে সেই ব্যথা সহ্য করলেন। তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল।
ডাক্তার বললেন, আমাদের শহরে যেসব মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে, তাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনার দাঁত তোলার সময় অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহার করা হলো না।
অ্যানেসথেসিয়া বা চেতনানাশক ব্যবহার করতে হবে না। এই দেশের মানুষের চেতনা এমনিতেই নাশ হয়ে আছে। তা নাহলে যে মেয়েটি ফুলের সঙ্গে টব ছুড়ে মেরেছিল পুলিশের ট্যাংকসদৃশ যানটিতে, তাকে চুলের মুঠি ধরে টানাহেঁচড়া করা এবং কোমরে বুটসমেত লাথি মারার পর আমরা তর্কে ব্যাপৃত হব কেন যে, মেয়েটি শুধু ফুল না মেরে টব ছুড়তে গিয়েছিল কেন? আমরা কেউ এই কথা বলছি না যে, মেয়েটি কেন রাজপথে গেল। মেয়েটির মনে কী দুঃখ?
মেয়েটির মনে যে দুঃখ, তার কারণ এই দেশের পুরুষপুঙ্গবেরা যেকোনো ভিড়ে নারীশরীর দেখলেই ঘটিয়ে থাকে, তাতে সাদা-কালো, বৃদ্ধ-তরুণ, ছাত্রলীগ-ছাত্রদল ইতরবিশেষ করতে হয় না। অপরাধীদের শাস্তি না হওয়া বড় অপরাধ, কিন্তু প্রত্যেক ঘরে নিজের ছেলেসন্তানটিকে মানুষ করার দায়িত্ব এবং নিজের ভেতরের পুরুষ-পশুটাকে বেঁধে রাখার দায়িত্বও আমাদের সবার।
না, কেবল লাতিন আমেরিকা থেকে ধার করে লিখলে চলবে কেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে বলি, ‘অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’। নজরুল ইসলাম থেকে বলি, ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।’
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.