জঙ্গি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হচ্ছে by রোজিনা ইসলাম

জঙ্গি সংগঠন ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’কে (এবিটি) নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী এ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হবে। ইতিমধ্যে এ-সংক্রান্ত নথিপত্র তৈরি করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি ঘোষণা করবে।
এর আগে ২০০৫ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি বি) ও শাহাদাত আল হিকমাতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এরপর ২০০৯ সালে হিযবুত তাহ্রীরকে নিষিদ্ধ করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের চেয়েও বড় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তারা আল-কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণ করে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ ধারা অনুযায়ী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানানো হয়। এরপর মন্ত্রণালয় সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করে গতকাল বলেন, সংগঠনটির বিরুদ্ধে একটার পর একটা ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তারা লেখক, ব্লগার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের হত্যা করছে, হুমকি দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পুলিশ সদর দপ্তর অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিয়েছে। সে অনুযায়ী আমরা সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ চার শিক্ষক, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে তাঁদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার পর সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের কথা জানা গেল। ‘আল কায়েদা-আনসারুল্লাহ বাংলা-১৩’ নামের একটি সংগঠন গত বুধবার ডাকযোগে চিঠি পাঠিয়ে এ হুমকি দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইসফাক ইলাহি চৌধুরী গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে এখনো কেন নিষিদ্ধ করা হয়নি, সেটাই তো আশ্চর্য লাগছে। রাজীব হত্যার পরই তাদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এনে বিচার করা উচিত ছিল। আমি আজও দেখেছি, তাদের ওয়েবসাইট উন্মুক্ত এবং সেখানে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে।’
ইসফাক বলেন, ‘শুধু ঘোষণা দিয়ে এসব জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করলে সমস্যা কমবে না। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মদক্ষতা বাড়াতে হবে। এদের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। জনসচেতনতা তৈরি করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও সেমিনার করে মানুষকে জানাতে হবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভূমিকা রাখতে হবে। না হলে এ সংকট কমবে না।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম একটি সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন। সংগঠনটি ২০১৩ সাল থেকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। বাংলাদেশের যুবকদের উগ্রপন্থী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে জিহাদের মাধ্যমে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়াই সংগঠনটির মূল লক্ষ্য। সংগঠনটি তাদের মতাদর্শ প্রচারের জন্য মসজিদকেও ব্যবহার করে থাকে। সংগঠনটির হামলার মূল লক্ষ্য হলো মুক্ত চিন্তার অনুসারী, ব্লগার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট বরগুনা জেলার একটি মসজিদে জঙ্গি হামলা ও নাশকতার পরিকল্পনা করার সময় সংগঠনটির নেতা মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীসহ ৩০ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারা ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যা করে। এ হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাঁচজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, যাঁরা পরে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন। একই বছরের ১৪ জানুয়ারি ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে এবং ৭ মার্চ সানিউর রহমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালানো হয়। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রীর ওপর হামলা চালান। এতে অভিজিৎ রায় নিহত ও তাঁর স্ত্রী গুরুতর জখম হন। গত ৩০ মার্চ ব্লগার ওয়াসিকুর রহমানকে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
জানা যায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে বাংলাদেশে সক্রিয় গোষ্ঠীর ওয়েবসাইট ও একাধিক ব্লগে আল-কায়েদার মতাদর্শ নিয়ে প্রচার, উদ্বুদ্ধকরণমূলক লেখা, অডিও-ভিডিও বক্তৃতা, আলোচনা, পরামর্শ, প্রশ্নোত্তর ইত্যাদির চর্চা করা হয়। বিদেশি জঙ্গি নেতাদের লেখা, বক্তৃতা-বিবৃতি বাংলায় অনুবাদ করে এই সাইটে প্রচার করা হয়।
আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামটিও ইরাকি আল-কায়েদার আনসার উল ইসলাম-এর অনুকরণে নেওয়া। তবে বাংলাদেশি এই গোষ্ঠী আধ্যাত্মিক নেতা মানেন ইয়েমেনভিত্তিক আল-কায়েদার নেতা আনওয়ার আওলাকিকে। আল-কায়েদা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা (আরব উপদ্বীপ) নামে সক্রিয় এই গোষ্ঠীর প্রধান আওলাকি ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মার্কিন ড্রোন (চালকবিহীন বিমান) হামলায় ইয়েমেনে নিহত হন।
দেশের নামকরা একাধিক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক এই গোষ্ঠীর যাত্রা ২০০৮ সালে। তখন রাজধানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক ক্যাম্পাসের কাছাকাছি বনানীর একটি মসজিদকে ঘিরে আল-কায়েদার মতাদর্শে বিশ্বাসী এ গোষ্ঠীর কার্যক্রম শুরু হয়। প্রধানত ইংরেজি মাধ্যম বা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে তাদের মতাদর্শ প্রচার ও উদ্বুদ্ধকরণ চলত। পরে ফেসবুক, ব্লগসহ তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্রিক কার্যক্রম শুরু করা হয়। শুরুতে এ দল বা গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট কোনো নাম ছিল না। তবে এর সদস্যরা ঘনিষ্ঠজনদের কাছে নিজেদের আল-কায়েদাপন্থী হিসেবে পরিচয় দিতেন বলে নর্থ সাউথের শিক্ষার্থীদের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু একই সময়ে হিযবুত তাহ্রীরের ব্যাপক কার্যক্রম থাকায় নতুন এই গোষ্ঠীর তৎপরতা আলাদাভাবে নজরে পড়েনি।

No comments

Powered by Blogger.