উদ্ধার করেনি কোনো সরকার by শেখ মামুনূর রশীদ

বছরের পর বছর ধরে বেদখলে থাকা রেলওয়ের তিন হাজার একর জমি উদ্ধারে মাথাব্যথা নেই কর্তৃপক্ষের। বরং নির্বিঘ্নে এ জমির ওপর গড়ে উঠছে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থায়ী অবকাঠামো। শুধু তাই নয়, এসব জমির ওপর ফ্ল্যাট বানিয়ে তা বিক্রি করছে বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানি।
ঢাকাসহ সারা দেশে বেহাত হওয়া রেলওয়ের এসব জমি উদ্ধারে বিগত প্রায় সব সরকারই ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দিয়েছিল নানা পদক্ষেপের। পাশাপাশি এই জায়গা উদ্ধারে মন্ত্রণালয়ের ওপর নানা চাপ সৃষ্টি করেছিল বিভিন্ন সরকার আমলের সংসদীয় কমিটি। কিন্তু সবকিছুই ছিল নিষ্ফল। বরং সব আমলেই বেড়েছে দখলের পরিমাণ ও জমির ওপর গড়ে ওঠা স্থাপনার সংখ্যা। এর ব্যত্যয় ঘটেনি বর্তমান সরকার আমলেও। একই পথেই হাঁটছে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও এ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। জমি উদ্ধারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় বুধবার অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটি বৈঠকে মন্ত্রীর ওপর ক্ষোভ ঝেড়েছেন কমিটির সদস্যরা। তাদের অভিযোগ- ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারা দেশে রেলওয়ের প্রায় তিন হাজার একর জমি বেহাত হয়ে গেছে। এর মধ্যে টঙ্গী থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত রয়েছে প্রায় ৩শ’ একর জমি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় প্রভাবশালী একাধিক মহল এসব জমি দখল করে সেখানে গড়ে তুলেছে দোকানপাট, বস্তি, কাঁচা মার্কেট, বাসাবাড়িসহ অবৈধ স্থাপনা।
সংসদীয় কমিটির আরও অভিযোগ, সম্প্রতি অবৈধ দখলদারদের এ তালিকায় যোগ দিয়েছে নামিদামি বিভিন্ন ডেভলপার কোম্পানি। জাল দলিল ও কাগজ তৈরি করে এসব কোম্পানি ফ্ল্যাট এবং বিপণিবিতান বানিয়ে বিক্রি করছে। শাহজাহানপুরে রেওলয়ের একটি জমিতে সম্প্রতি স্বনামধন্য একটি ডেভলপার কোম্পানি নয় তলা ভবন তৈরি করেছে। এর আগে তারা জমির জাল দলিল এবং কাগজপত্র তৈরি করে ভবন নির্মাণের জন্য রাজউক থেকে অনুমোদন নেয়। এছাড়া রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার আনন্দবাজার এলাকায় রেলওয়ের ২ দশমিক ৮৭ একর জায়গা দখলে নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল বিপণিবিতানসহ শতাধিক স্থাপনা। মন্ত্রণালয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রেলের জমিতে কিভাবে ফ্ল্যাট ও বহুতল বিপণিবিতান নির্মাণ হল, তা খতিয়ে দেখার জন্য মন্ত্রণালয়কে বলেছে সংসদীয় কমিটি। এজন্য প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেয়ার কথাও বলেছেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা। তাদের অভিযোগ, রেলওয়ের একশ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এবং প্রায় সব ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের আশীর্বাদে নির্বিঘ্নে রেলওয়ের জমিতে গড়ে উঠেছে এসব অবৈধ অবকাঠামো। কমিটির সদস্যদের অভিমত- রেলের বেহাত হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধার করে প্রয়োজনে লিজ দেয়া যেতে পারে। এতে সরকারের আয় বাড়বে। মন্ত্রণালয়ও লাভবান হবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের কার্যপত্র ও সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী বলেন, এটা সত্য রেলের জমির একটি বড় অংশ বেদখলে। সংসদীয় কমিটি একাধিকবার এসব জমি উদ্ধারে মন্ত্রণালয়কে বলেছে। এছাড়াও রেলওয়ে জমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার স্বার্থে রেলের কি পরিমাণ জমি কতজনকে বৈধভাবে লিজ দেয়া হয়েছে, তাদের সঙ্গে কি চুক্তি ছিল, চুক্তি অনুযায়ী তা সঠিকভাবে পালন করা হয়েছে কিনা- সেসব বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটিকে দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।
সভাপতি জানান, এছাড়া রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের অবৈধ বিলবোর্ডগুলো আগামী এক মাসের মধ্যে উচ্ছেদ এবং রেলওয়ে একটি হেল্পলাইন চালু করার বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করেছেন তারা।
রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক বৃহস্পতিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, বেদখলে যাওয়া রেলের জমি উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু জমি উদ্ধার করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
সংসদীয় কমিটির তথ্যানুযায়ী টঙ্গী থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ স্টেশন পর্যন্ত রেলওয়ের প্রায় তিনশ’ একর জমি দখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারে থাকা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় এসব জমি দখল করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর রেলওয়ে কর্তৃৃপক্ষ ৯৪১ জন দখলদারের নামের একটি তালিকা তৈরি করে। যাদের দখল ছেড়ে দেয়ার চিঠিও দেয়া হয়, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
সংসদীয় কমিটিকে দেয়া মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযাযী সারা দেশে রেলওয়ের মোট ৬১ হাজার ৬০৫ দশমিক ৮৪৯ একর জায়গা আছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ২৪ হাজার ৪০১ দশমিক ৬২ একর এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৩৭ হাজার ২০৪ দশমিক ২২৯ একর। এ সম্পত্তির মধ্যে উভয় অঞ্চল মিলে প্রায় তিন হাজার একর জমি বেদখলে রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রেলওয়ের জমি রয়েছে প্রায় ১২শ’ একর। আর ৩শ’ একর জমি বেদখলে রয়েছে টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ স্টেশন পর্যন্ত ৩৫ কিমি. রেললাইনের দু’পাশে (প্রতি পাশে ২০ ফুট হিসাবে) এবং ১৭২ একর জমি দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বিমানবন্দর ও তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় ১৯ একর, কমলাপুরে ২ একর, ফুলবাড়িয়া আনন্দবাজার এলাকায় ৩ একর, নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে ২৯ একর জমি দখল হয়ে গেছে। জমির পাশাপাশি রেলওয়ের প্রায় ৭ হাজার ২শ’ বাড়ি (সরকারি কোয়ার্টার) অবৈধ দখলে রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.