অস্তিত্ব সংকটে জাতীয় পার্টি by সিরাজুস সালেকিন

অস্তিত্ব সংকটে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির। দলীয় বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত। সম্প্রতি সিটি নির্বাচনে ভরাডুবির পর হতাশা নেমে এসেছে দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকা নিয়েও চলছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। দলীয় কোন্দল, কমিটি গঠন, সাংগঠনিক দুর্বলতা, বহিষ্কারসহ নানা ইস্যুতে সংসদের প্রধান বিরোধী দলের এখন হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সব মিলিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জে পড়েছে দলটি। বিষয়টি স্বীকার করে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, জাতীয় পার্টি এখনও ঠিকে আছে এটিই বড় কথা। দলীয় সূত্র জানায়, জাতীয় পার্টিতে এরশাদ রয়েছেন কোণঠাসা অবস্থায়। পার্টিতে তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আর দলের ভেতরে চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও রওশনের দ্বন্দ্বের বিষয়টি এখন প্রকাশ্যে। রওশনপন্থি শীর্ষ নেতারা সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তারা দল গোছানোর চাইতে নিজেদের আখের গোছাতেই বেশি ব্যস্ত। অন্যদিকে দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা অধিকাংশই এরশাদপন্থি। এরশাদের কোন কর্মসূচিতে জাতীয় পার্টির মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা এমপিরা সচরাচর যান না। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান দেন বলেও অভিযোগ আছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ সক্রিয় নেতাকর্মীরা। এমপিদের একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ময়মনসিংহ-৭ আসনের এমপি এম এ হান্নান। তাকে এরশাদের কর্মসূচিতে মাঝে মধ্যে দেখা যেতো। গত মঙ্গলবার তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, গত দেড় বছরে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারেনি জাতীয় পার্টি। মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকা নিয়েও অস্থিরতা চলছে দলের ভেতরে। গত রোববার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিসভা থেকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের পদত্যাগের বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, বছরের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে পদত্যাগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। দলের অস্তিত্ব টিকে আছে দাবি করে তিনি বলেছেন, এটা অনেক বড় সাফল্য। তবে সূত্র জানিয়েছে ক্ষমতায় অংশীদার জাতীয় পার্টির মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা পদত্যাগে আগ্রহী না। দলের কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় পার্টির মূল সংকট চলছে নেতৃত্বকে ঘিরে। মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। প্রেসিডিয়ামের একটি অংশ নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করে। সিটি নির্বাচনে লজ্জাজনক হারের পেছনে বর্তমান মহাসচিবের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডকে দায়ী করছেন তারা। বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ ও পরিশ্রমের পরও প্রত্যাশিত ফল পাননি জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীরা। তিন সিটিতে মাত্র ১৩ হাজার ৬০০ ভোট পেয়েছেন মেয়রপ্রার্থীরা। দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদেরও ভোটের ক্ষেত্রে একই হাল ছিল। জাপার ৮১ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে জয় পেয়েছেন মাত্র একজন। দলের  মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু  প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করায় জাপার এই পরিণতি বলে চেয়ারম্যানের কাছে কয়েকজন নালিশ করেছেন। অথচ এই সিটি নির্বাচনকে ঘিরে দলের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ঢাকা উত্তরে মেয়রপদে মনোনয়ন সংগ্রহ করায় অব্যাহতি দেয়া হয়েছে চেয়ারপারসন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উপদেষ্টা ববি হাজ্জাজকে। আর ববি হাজ্জাজকে সমর্থন করায় অব্যাহতি দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাককে। সিটি নির্বাচনের পর নেতাকর্মীদের সামনে আসছেন না দলের সিনিয়র নেতারা। প্রায় একমাস পেরিয়ে গেলেও ঘরোয়া বৈঠক ছাড়া দলীয় কোন কর্মসূচি নেই জাপার।
বর্তমান মহাসচিবের অধীনে সারা দেশে কাউন্সিল অধিবেশনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের বিষয়টিও ঝুলে গেছে। গত ডিসেম্বরে কাউন্সিল শেষ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা শুরুই হয়নি। কাউন্সিল হলে নতুন নেতৃত্ব আসতে পারে এই ভয়ে নীরব আছেন দলের সিনিয়র নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন যুগ্ম মহাসচিব জানান, কাউন্সিল করতে নির্বাচন কমিশন থেকে চাপ আছে। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করছেন যেন কাউন্সিল হয়। কিন্তু যারা দলের ভাল চায় না তারাই কাউন্সিল আটকে রেখেছে।
জানা গেছে, জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক জেলা ৭৬টি। এর মধ্যে মাত্র একটি জেলায় কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি করা হয়েছে। আর তা হলো রাজশাহী। বাকি ৭৫টি জেলায় কোন কমিটি হয়নি। এসব জেলার মধ্যে অন্তত ২৫টি জেলা আহ্বায়ক কমিটি এবং বাকিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে। গত বছরই সাংগঠনিক জেলার ৩৩টিতে সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটি করার জন্য চিঠি দেয়া হয়ছিল। কিন্তু এসব জেলার কেউই তখন সেই চিঠির জবাব দেননি। ফলে তারা সম্মেলন করবেন কিনা তাও জানতে পারেনি কেন্দ্রীয় কমিটিকে। তবে এ অবস্থায় পরের পদক্ষেপ কী হবে তাও নির্ধারণ করতে পারেনি দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। আরও জানা গেছে, এমন কিছু সাংগঠনিক জেলা আছে, যেগুলোতে এক যুগের বেশি সময়ে কোন কাউন্সিল হয়নি। এরকম জেলার মধ্যে রয়েছে বরিশাল মহানগরে ১১ বছর ও জেলায় ১৪ বছর কোন কাউন্সিল হয়নি। অপরদিকে খুলনায় ৭ বছর কোন কাউন্সিল হয়নি। তবে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু মানবজমিনকে বলেন, আমাদের কাউন্সিল হচ্ছে না এটা ঠিক না। ৭৬টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ইতিমধ্যে ১৮টিতে আমরা কাউন্সিল করেছি। রমজানের আগে বেশ কয়েকটি জেলায় কাউন্সিল করব। হরতাল অবরোধের কারণে কাউন্সিল আটকে ছিল। জাপার মন্ত্রীদের পদত্যাগ সম্পর্কে তিনি বলেন, চেয়ারম্যান প্রেসিডিয়ামের সঙ্গে পরামর্শ করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পদত্যাগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। সম্প্রতি জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদের ফেসবুকে জাতীয় পার্টির কঠোর সমালোচনা করেন। বর্তমানে জাতীয় পার্টির নিজস্ব কোন রাজনীতি নেই এবং দলকে সরকারের সকল ‘অপকর্মের’ দোসর বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে কেন্দ্রীয়ভাবে দলের এ হ-য-ব-র-ল অবস্থার স্পষ্ট ছাপ পড়েছে তৃণমূলেও।

No comments

Powered by Blogger.