দুই শিশুর মাথা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে গেছে খুনিরা by আনু মোস্তফা ও জোবদুল হক

শনিবার সকাল। চরবাবুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী লতিফা আর আঁখি। প্রতিদিনের মতোই বইখাতা নিয়ে স্কুলের পথে বাড়ি থেকে বের হয় ফুটফুটে দুই শিশু। সেদিন স্কুল ছুটির পর আর বাড়ি ফেরেনি তারা। তিন দিন খোঁজাখুঁজির পর বুধবার দুপুরে তাদের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরের এক ভুট্টা ক্ষেতে মস্তক ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গবিহীন ক্ষতবিক্ষত দুটি লাশ পাওয়া গেছে। নৃশংসভাবে হত্যার পর শিশু দুটির কিডনিসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গও কেটে নিয়ে গেছে সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা। কেটে নিয়ে গেছে তাদের কচি মাথাটাও। এই রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নের পদ্মা তীরের সীমান্তবর্তী গ্রাম কানছিড়া ডাক্তারপাড়ায়। ফুটফুটে দুই শিশুর এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে গ্রামজুড়ে ক্ষোভ ও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। লতিফা ও আঁখিকে চিরতরে হারিয়ে তাদের পরিবার ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে এলাকার বাতাস।
এদিকে লতিফা ও আঁখির সহপাঠীসহ চরবাবুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও শোকে কাতর। লতিফা ও আঁখি এই স্কুলেরই তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। পুলিশ জানিয়েছে, ময়নাতদন্তের পরই জানা যাবে কিভাবে শিশু দুটিকে হত্যা করা হয়েছে। তবে লতিফা ও আঁখির পরিবারসহ গ্রামবাসী অভিযোগ দেয়ার পরও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ এনেছেন।
লতিফা ও আঁখির খোঁজে তিন দিন : উপজেলা সদর থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমের পদ্মার তীরবর্তী কানছিড়া ডাক্তারপাড়া গ্রাম। গ্রামের আবদুল লতিফের ছোট মেয়ে লতিফা (৯) ও একই গ্রামের আশরাফুলের বড় মেয়ে আঁখি (৯)। দুপুরে স্কুল ছুটির পরও তারা বাড়ি না ফেরায় শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। সম্ভাব্য জায়গায় না পেয়ে লতিফ ও আশরাফুল মেয়েদের খোঁজে ছুটে যান চরবাবুপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রইস উদ্দিনের বাড়িতে। প্রধান শিক্ষক তাদের জানিয়ে দেন লতিফা ও আঁখি ওইদিন স্কুলেই যায়নি। পরিবারের লোকজন আশপাশের গ্রামে ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ফোন করে খোঁজ নেন। অবশেষে মসজিদের মাইক থেকে মাইকিং করা হয়। এভাবে কেটে যায় আরও একটি দিন। অবশেষে গ্রামবাসীর পরামর্শে ৩০ মার্চ আবদুল লতিফ ও আশরাফুল শিবগঞ্জ থানায় পৃথক দুটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
যেভাবে উদ্ধার হল : বুধবার সকালে কানছিড়া ডাক্তারপাড়ার বেলালসহ আরও কয়েকজন জমিতে পাকা গম কাটছিলেন। ভুট্টা ক্ষেতের যে জায়গাটায় শিশু দুটির লাশ পাওয়া যায় তার উত্তরে গম কাটছিলেন বেলালরা। বেলালের ভাষায় সকাল থেকেই দক্ষিণা বাতাসে উৎকট গন্ধ নাকে লাগছিল। কোথাও কিছু মরে আছে মনে হল। বাতাসের গতি বাড়তে থাকায় মরা কিছুর গন্ধও আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এ সময় সবাই মিলে গন্ধকে অনুসরণ করে কিছুটা এগোতেই ভুট্টা ক্ষেতের মাঝামাঝি দেখতে পাওয়া যায় একটি শিশুর গলাকাটা লাশ। তার একশ’ গজ দূরে দেখা গেল আরেক শিশুর ক্ষতবিক্ষত দেহ। মুহূর্তের মধ্যেই খবরটি ছড়িয়ে পড়ে গ্রামময়। গ্রামের শত শত মানুষ ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। ছুটে আসেন লতিফার বাবা আবদুল লতিফ ও আঁখির বাবা আশরাফুলসহ ভাইবোনরা। কার লাশ কোনটা তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্তের সুযোগ না থাকায় পরনের জামা-কাপড় দেখেই তারা চিনতে পারেন লতিফা ও আঁখিকে। পুলিশকে খবর দেওয়া হলে শিবগঞ্জ থানার ওসি ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠান ময়নাতদন্তের জন্য।
হত্যার পর কেটে নেয়া হয়েছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ : বুধবার দুপুরের পর ঘটনাস্থলে পৌঁছে দুই শিশু লতিফা ও আঁখির লাশের সুরতহাল প্রস্তুত করেন শিবগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নূরে আলম। সুরতহাল প্রতিবেদনে দেখা যায়, হত্যার পর দুর্বৃত্তরা শিশু দুটির মাথার চুল কেটে ফেলে। লাশের কাছেই পড়ে রয়েছে কাটা চুলের গোছা। দুটি লাশের কোনোটিতেই মাথা নেই। জামা-কাপড় ও সেন্ডেল পড়ে রয়েছে লাশের খানিটা দূরে। এসআই নূরে আলম বলেন, শিশু দুটিকে কাছাকাছি জায়গায় পৃথক দুটি স্থানে গলা কেটে হত্যা করা হয়। মস্তকও দুর্বৃত্তরা নিয়ে গেছে। দুই লাশেরই পিঠের নিচে গর্ত করে কাটা।
এতে ধারণা করা হচ্ছে শিশু দুটির কিডনিগুলো কেটে নিয়েছে হত্যাকারীরা। লতিফার একটি পাও দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ঘটনাস্থলে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখে ধারণা করা হচ্ছে গলা কেটেই শিশু দুটিকে হত্যার পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে নেয়া হয়েছে। নূরে আলম বলেন, শিশু দুটির খুন নৃশংসতায় পূর্ণ। শিবগঞ্জ থানার ওসি ময়নুল ইসলাম বলেন, যেদিন নিখোঁজ হয়েছে সেদিনই শিশু দুটিকে হত্যা করা হয় বলে আমরা ধারণা করছি। তবে ময়নাতদন্তে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
অভিযোগ পেয়েও ঘটনাস্থলে যায়নি পুলিশ : ২৮ মার্চ শিশু ছাত্রী লতিফা ও আঁখি নিখোঁজের একদিন পর ৩০ মার্চ শিবগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন দুই শিশুর বাবা। কিন্তু গ্রাম থেকে আকস্মিকভাবে দুটি স্কুলপড়ুয়া শিশু নিখোঁজ হলেও পুলিশ এ ব্যাপারে নিয়মমাফিক বার্তা প্রেরণ ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থলে কোনো কর্মকর্তাকেও পাঠানো হয়নি। আঁখির বাবা আশরাফুল বলেন, অভিযোগ পাওয়ার দিন পুলিশ গ্রামে এলে দুর্বৃত্তদের কাউকে না কাউকে ধরা যেত। লতিফার বাবা আবদুল লতিফ বলেন, পুলিশ তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিলে ঘটনার পরপরই খুনিরা ধরা পড়ত। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওসি বলেন, পুলিশ দুই শিশুর নিখোঁজের ব্যাপারে দেশের সব থানায় বার্তা পাঠিয়েছে। তবে জিডিগুলো তদন্তের দায়িত্ব কাদের দেয়া হয়েছিল তা জানাতে পারেননি তিনি।
পরিবারের আহাজারি : বুধবার দুপুরে লতিফা ও আঁখির লাশ উদ্ধারের পর থেকেই সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আছেন আবদুল লতিফ। লতিফার মা হাসনারা খাতুনও বিলাপ করছেন মেয়ের শোকে। লতিফার বড় ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে থামাতে পারছে না আত্মীয়পরিজনরা। শিশু আঁখির পরিবারেও চলছে শোকের মাতম। বাবা আশরাফুলকে বাড়িতে ধরে রাখতে পারছেন না কেউ। ছুটে যাচ্ছেন লাশের দিকে। আঁখির মা লিপি খাতুন ঘটনা শোনার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আঁখির মা শুধু বলছেন, তোমরা আমার মেয়েকে এনে দাও। স্কুল যাওয়ার আগে বলেছিল, ফিরে এসে নানি বাড়ি যাবে। আমার আঁখিকে তোমরা এনে দাও।
পুলিশ যা বলছে : শিবগঞ্জ থানার ওসি এসএম ময়নুল ইসলাম বলেন, ধারণা করা হচ্ছে গ্রামেরই কতিপয় দুর্বৃত্ত শিশু দুটিকে ফুসলিয়ে গ্রামের বাইরে ভুট্টা ক্ষেতের দিকে নিয়ে যায়। হত্যার পর লাশ গুম করার চেষ্টা করার কারণেই মাথা কেটে নিয়ে গেছে। দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কেটে নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হতে পারে এগুলো কেটে পার্শ্ববর্তী পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চোর সিন্ডিকেটের কাজ এটি কিনা তা নিশ্চিত নয় পুলিশ। খুনিরা ধরা পড়লে বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে তিনি মনে করছেন। কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত জানতে চাইলে ওসি আরও বলেন, গ্রামেরই কয়েকজন হতে পারে। যারা লতিফা ও আঁখি নিখোঁজের পর থেকে গ্রামের বাইরে অবস্থান করছে। এসব যুবকের আচরণও ঘটনার পর থেকে সন্দেহজনক বলে ওসি জানিয়েছেন। তবে দ্রুত খুনিদের শনাক্ত করার আশা করছেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.