জানার অধিকার প্রতিষ্ঠায় রক্তাক্ত লড়াই by হামিদ মির

২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল পাকিস্তানের বন্দর শহর করাচিতে ঘাতকেরা আমার শরীরে ছয়টি বুলেট গেঁথে দেয়। আমার মনে হয়েছিল, মৃত্যুর সঙ্গে করমর্দন করলাম। সেও যেন তার দুনিয়ায় আমাকে স্বাগত জানাল। কিন্তু মানুষের বোধের অতীত এক কারণে আমি যেন জীবনের সীমানায় ফিরে এলাম। সেই দিনটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক দিন। তার কিছুদিন আগেই আমি অনেক হুমকি পেয়েছি। ফলে সেদিন ইসলামাবাদ থেকে করাচি যাওয়ার ব্যাপারে আমি তেমন একটা আগ্রহী ছিলাম না। দিনটিও যেন কেমন নিরানন্দ ছিল। নিরাপত্তার কারণেই আমি এক মাসের ছুটিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। আমার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকেও আমি এসব হুমকির ব্যাপারে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম।
জিয়ো নিউজের চলতি ঘটনাবলির পরিচালক খুব উদ্গ্রীব ছিলেন, আমি যেন আত্মঘাতী হামলার ব্যাপারে করাচি থেকে এক বিশেষ অনুষ্ঠান করি। বিশেষ করে মার্কিন ড্রোন হামলায় ১০০ দিনের বিরতি থাকলেও আত্মঘাতী হামলার পরিমাণ কমেনি কেন, সে বিষয়টি অনুসন্ধান করতে তিনি আমাকে বারবার তাগাদা দিয়েছেন। অনুষ্ঠানটি আমি ইসলামাবাদ থেকে করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে টিভি স্টেশনের কিছু প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ছিল। আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম, করাচিতে আমার কোনো জ্যেষ্ঠ সহকর্মী কাজটা করতে পারেন। কিন্তু পরিচালক সাহেবের মনে অন্য চিন্তা ছিল। এমন একটি সংবেদনশীল বিষয় তিনি আমার অভিজ্ঞ হাতেই অর্পণ করতে চান। শেষমেশ, পেশাগত দক্ষতাই আমার হুমকি হয়ে উঠল।
জিয়ো নিউজ আটজন অতিথি নিয়ে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী এক টক শো করার পরিকল্পনা করছিল। আমি আমার অশুভ কামনাকারীদের চোখে ধুলো দিতে এক বেসরকারি এয়ারলাইনসে ইসলামাবাদ থেকে কোয়েটার টিকিট কিনি। শুধু ১৯ এপ্রিল সকালবেলায় আমি বিমান পরিবর্তন করি। আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমার শত্রুরা আমার চেয়ে চৌকস। আমার চালাকিও শেষমেশ কাজ নাও করতে পারে। স্ত্রীকেও আমার এই আশঙ্কার কথা জানালাম। আমার যাত্রার নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সে এক ছাগল সদকা দিল।
করাচি বিমানবন্দরে পৌঁছা মাত্র স্ত্রীকে খুদে বার্তা পাঠালাম। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, ‘কোথাও যেন গড়বড় আছে’। অফিস চালকসহ এক গাড়ি পাঠিয়েছিল। চালককে জিজ্ঞেস করলাম, নিরাপত্তারক্ষী কোথায়? উত্তরে সে জানাল, তার কাছে পিস্তল থাকায় পুলিশ তাকে বিমানবন্দরে ঢুকতে দেয়নি। তাকে আমরা বিমানবন্দরের বাইরে থেকে তুলে নিলাম। ইতিমধ্যে অফিসেও জানিয়ে দিয়েছি যে আমি করাচিতে পৌঁছেছি। নাথা খান সেতুর কাছে আসার পর গুলির শব্দ পেলাম। পরক্ষণেই বুঝে গেলাম, আমিই এর লক্ষ্যবস্তু। বুলেট এসে লাগল আমার ডান কাঁধে। চালক ভয় পেয়ে গেল। আমার মনে আছে, চালককে দ্রুত পালিয়ে যেতে বলেছিলাম।
পশ্তু গাড়িচালকের স্নায়ুর প্রশংসা করতেই হবে। সে ভয়ে কাণ্ডজ্ঞান হারায়নি। হামলাকারীরা পেশাদার ছিল, প্রশিক্ষিতও বটে। এরপর শুরু হয় প্রতিযোগিতা। দুটি মোটরবাইক করাচির সড়কে এঁকেবেঁকে আমাদের ধাওয়া করছিল। ঠিক যেন মৌমাছির ঝাঁক শত্রুকে ধাওয়া করছে। আর গুলিও করছে, যাতে অন্তত একটা গুলি জায়গামতো লাগে। অনেকটা হলিউডের ছবির মতো। আরও কয়েকটা গুলি আমার শরীরের নিচের দিকে এসে লাগে, পিঠের নিচে এবং ডান ও বাম ঊরুতে। সহকর্মীদের ফোন করে বললাম, আমার ওপর আক্রমণ হয়েছে। তাঁরা আমাকে দ্রুত কোনো হাসপাতালে ঢুকে যেতে বললেন।
চালককে বললাম, ‘আমার রক্ত ঝরছে, হাসপাতালে নিয়ে চলো।’ সামনের আসনে যে বেলুচ রক্ষী ছিল, সে বলল, আগা খান হাসপাতালই নিরাপদ হবে। হামলাকারীরা মিনিট দশেক আমাদের ধাওয়া করেছে। এর মধ্যে সেই রক্ষী সামনের আসন থেকে উঠে পেছনের আসনে এসে হামলাকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করে। আগা খান হাসপাতালের কাছে এলে পাকস্থলীতে আরও কয়েকটা গুলি লাগে, আরেকটি গুলি আমার মূত্রথলি ছিদ্র করে দেয়। ফলে আমার ক্ষুদ্রান্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ সে সময় ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হয়েছে?’ উত্তরে তাঁকে বললাম, ‘আমার ওপর হামলা হয়েছে’। আগা খান হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছে আমি নিজেই গাড়ি থেকে নামার চেষ্টা করলাম। তখন বুঝলাম, আমার দুই পায়েই গুলি লেগেছে। মনে মনে ভাবলাম, মরতে যাচ্ছি। ‘কলেমা তাইেয়বা’ পড়তে শুরু করলাম। ভাবছিলাম, মেয়ে আমার মৃত্যুসংবাদ কীভাবে নেবে। আমি তার জন্য দোয়া করলাম। এর পরই জ্ঞান হারালাম।
পরের দিন খুব অল্প সময়ের জন্য জ্ঞান ফেরে আমার। মুখের ওপর অক্সিজেন মুখোশ লাগানো। চিকিৎসক মুখে হাসি নিয়ে বললেন, ‘এটা প্রায় অলৌকিক ঘটনা যে আপনি বেঁচে গেছেন। আপনি এখন ঠিক আছেন।’ তখন মনে হচ্ছিল, বেঁচে হয়তো গেছি। কিন্তু সব ঠিক নেই। সেই ঘটনার কিছুদিন আগে কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমাকে সতর্ক করেছিলেন, আমি যেন মামা কাদের বেলুচকে টক শোতে আমন্ত্রণ না জানাই। আর বেলুচিস্তানের গুম এবং পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে আনীত দেশদ্রোহ মামলার বিষয়ে যেন কিছু না বলি। কিন্তু পেশাদারি দায়িত্বের আলোকে আমি সেই সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেছিলাম।
হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর ভাবছিলাম, আমার অপরাধ কী। সম্ভবত, এটাই আমার অপরাধ। হাসপাতালের শয্যায় পা নাড়ানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। আমি প্রচণ্ড আঘাত পাই। কথা বলার চেষ্টা করেও পারি না, আবার জ্ঞান হারাই। আমি জানতাম না, কিছু শক্তিশালী মানুষ এক শয্যাগত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সুসংঘবদ্ধ প্রচারণা শুরু করেছে। আমি আক্রান্ত, অথচ তারা আমাকে দুষ্কৃতকারী বানাতে চেয়েছে। আমার বিরুদ্ধে সব জায়গায় ঘৃণা ছড়ানো শুরু হয়—সম্প্রচারমাধ্যম, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আমাকে ও আমার টিভি চ্যানেলকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ অভিধা দেওয়া হয়। টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। ঘটনার তৃতীয় দিন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ আমাকে দেখতে এসে বলেন, আমার বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে উদ্ঘাটিত করতে তিনি এক তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তাঁর মুখে চিন্তা, উত্তেজনা ও চাপের বলিরেখা ছিল স্পষ্ট।
এই হামলার পর কিছু সেনা কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক সরকারের মধ্যে শীতলযুদ্ধ শুরু হয়। কারণ, আমার পরিবারের ধারণা ছিল, আইএসআই আমার ওপর হামলা করেছে। আইএসআই কর্মকর্তারা শুধু আমার টিভি চ্যানেলের প্রতিই ক্ষুব্ধ ছিল না, তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিও ক্ষুব্ধ ছিল। কারণ, তিনি আমার মতো ‘বিশ্বাসঘাতক’কে দেখতে হাসপাতালে গেছেন। জাতিসংঘ কর্তৃক নিষিদ্ধ জিহাদিগোষ্ঠী এলইটি (এখন জামাতুল দাওয়াহ নামে কাজ করে) রাস্তায় নেমে জিয়ো টিভির বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। তাদের হাতে আইএসআই–প্রধানের ছবি ছিল, তারা তাঁর সপক্ষে বক্তৃতাও দেয়। অন্যদিকে সব প্রধান রাজনৈতিক দল এবং বেলুচিস্তান ও সিন্ধের রাজ্যসভায় আমার সপক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজও আমার পক্ষে পথে নামে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে হাতে গোনা কয়েকজন শক্তিশালী মানুষের কাছে আমি দুষ্কৃতকারী আর ক্ষমতাহীন বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে আমি নায়কে পরিণত হই।
কিছুদিনের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতের তিনজন বিচারকের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তাঁদের হাসপাতালে আসার অনুরোধ করলেও তাঁরা সেটা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আমি না গেলে তাঁরা তদন্ত কার্যক্রম শুরু করতে পারবেন না। ফলে সেই অবস্থায় এক হাতে দুটি মেডিকেল ব্যাগ ও আরেক হাতে আমার লিখিত বক্তব্যের কপি নিয়ে আমি তাঁদের সামনে হাজির হই। শরীরের প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে পরবর্তী তিন সপ্তাহের মধ্যে আমি আরও দুবার তাঁদের সামনে হাজির হই। এক প্রখ্যাত রাজনীতিক আমাকে দেখতে এসে যে কথা বলেছিলেন, তা আমার এখনো মনে আছে, ‘আপনার জন্য আমার দুঃখ হয়। কিন্তু আপনার চ্যানেল তো শেষ। সেনা কর্মকর্তা আমাকে বলেছে, তারা জিয়ো নিউজ চলতে দেবে না। মানুষ আপনার সঙ্গে আছে, আপনার চ্যানেলের সঙ্গে নয়। সে কারণে আপনি অন্য কোনো চ্যানেলে যোগ দিন।’ আমি তাঁকে বললাম, ‘আমার জাহাজ হয়তো ডুবছে, কিন্তু আমি এর সঙ্গেই ডুবব, ছেড়ে যাব না।’
চিকিৎসকেরা ছয় মাসের বিশ্রামের পরামর্শ দিলেও আমি তিন মাস পরে কাজে যোগ দিই। তখনো আমার শরীরে
দুটি বুলেট রয়ে গেছে। সব দিক থেকেই জিেয়া টিভির ওপর হামলা হচ্ছিল। কেব্ল অপারেটরদের চাপ দিয়ে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল জিেয়া টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে চ্যানেল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। গত এক বছর আরও হুমকি সত্ত্বেও টিকে আছি, আপস করিনি। এদিকে আজ এক বছর অতিক্রান্ত হলেও তদন্তের ফল বেরোয়নি।
আমি বুঝতে পারি, পাকিস্তানের উচ্চ আদালতও সংবাদমাধ্যমের মতো চাপে আছেন। পাকিস্তান গণতান্ত্রিক দেশ হলেও সংসদ, বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যম এখনো স্বাধীন নয়। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম এক বছর ধরে শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনীর অঘোষিত এক নিকৃষ্ট সেন্সরের মুখে রয়েছে। আমি জানি, কিছু নিরাপত্তা সংস্থাও সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়ছে। ফলে আমাদের সমালোচনায় সতর্ক হতে হবে। যে সেনারা সন্ত্রাসবাদ রুখতে জীবন দিচ্ছেন, তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। কিছু ব্যক্তির ভুলের দায় তাঁদের কাঁধে বর্তায় না। আমি আমার পেশা ও পাকিস্তান ছাড়তে অস্বীকৃতি জানিয়েছি। অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমকে বিশ্বাস করে। কারণ, আমরা জনস্বার্থে ত্যাগ স্বীকার করেছি। আর আমার কাছে জনস্বার্থ মানেই জাতীয় স্বার্থ। আমি সাংবাদিক হিসেবে গর্বিত। কারণ, আমি জনগণের জানার অধিকারের দাবিতে লড়ছি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
হামিদ মির: পাকিস্তানের জিয়ো টিভিতে কর্মরত সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.