ভাল নেই গ্রামীণ ব্যাংক by হামিদ বিশ্বাস

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পদ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে ২০১১ সালের ১১ই মে। ৬০ বছরের চাকরির বয়সসীমার বাধ্যবাধকতার অভিযোগ তুলে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। সে সময় সরকার বলেছিল, ৬০ বছর পূর্ণ হয়ে গেছে। মেয়াদ শেষ। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকতে পারবেন না। এরই মধ্যে কেটে গেছে প্রায় চার বছর। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি ঘটনা- মান, অভিমান কিংবা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা অথবা যে কোন কারণেই হোক না কেন তিনি আর একবারের জন্যও গ্রামীণ ব্যাংকে ফিরে আসেননি। আরও বিস্ময়কর খবর হচ্ছে, দীর্ঘ চার বছরের বিষাদময় এ সময়ে তিনি একই ভবনের ১৬ তলায় অফিস করেন, যা ইউনূস সেন্টার হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ২ থেকে ৮ তলায় তারই স্বপ্নের গ্রামীণ ব্যাংক। যা তিনি চট্টগ্রামের জোবরা গ্রাম থেকে তিলে তিলে তৈরি করেন। চলে আসার পর সেখানে তিনি ভুলেও আর পা রাখেননি। গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) এএসএম মহিউদ্দিন বলেন, এমন অনেক দিন গেছে লিফটে দেখা হয়েছে। জানতে চেয়েছেন কেমন আছো কিন্তু কোন দিন অফিসে আসেননি। সোজা চলে গেছেন ১৬ তলায়। এ কথাগুলো যখন বলছেন তখন গ্রামীণ ব্যাংকের সিইও মহিউদ্দিনের দু’চোখ জলে টলমল। নিজেকে কিছুটা সংবরণ করে এএসএম মহিউদ্দিন বলেন, ব্যাংক তার নিজস্বগতিতে চলছে। তবে যা হারিয়েছি তা হয়তো জীবনেও আর ফিরে পাবো না। আদর, স্নেহ আর ভালবাসা। যে বটবৃক্ষের ছায়াতলে জীবনের অনেক বছর কাটিয়েছি, সে বটবৃক্ষ আজ থেকেও নেই। আছে তার স্মৃতি। রেখে যাওয়া আদর্শ। এখনও তার আদর্শ আঁকড়ে ধরে ভালোই আছি। তবে ভালো থাকতে হয়তোবা আর দেবে না। সংকোচিত হয়ে আসছে আদর্শের সে পথ। বাড়ছে রাজনৈতিক চাপ। ড. আকবর আলি খান ও অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মতো দেশের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদরা এক সময় গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করলেও বর্তমানে কেউ ব্যাংকটির দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক। দায়িত্বের কিছু দিন পর অপারগতা প্রকাশ করে তিনি সরকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু সরকার তরফে বলা হয়েছে, ভালো কাউকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তাকেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পর তিনি মাত্র ২টি বোর্ড মিটিংয়ে এসেছেন। বর্তমানে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। দীর্ঘ ৪ বছর পর্যন্ত সরকার গ্রামীণ ব্যাংকে এমডি নিয়োগ দিতে পারেনি। চলছে ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে। চেয়ারম্যান দিলেও পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এদিকে ৯ নারী পরিচালকের মেয়াদ চলতি বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি শেষ হয়েছে। নির্বাচন তো দূরে থাক, আজ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনও গঠন করতে পারেনি সরকার। ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়া সরকারের হাতে নেয়া ঠিক হয়নি উল্লেখ করে মহিউদ্দিন বলেন, এর মাধ্যমে ব্যাংকে রাজনীতি ঢুকতে পারে। ৯ নারী নির্বাচন নিয়েও রাজনৈতিক চাপের আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, একচেটিয়া কোন দলবিশেষের পরিচালক হলে বোর্ডের সিদ্ধান্ত একপেশে হতে পারে। এতে ব্যাংকের স্বাভাবিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে। সব মিলিয়ে সরকারের হস্তক্ষেপে ব্যাংকটি এক ধরনের টানাপড়েনে আছে বলে তিনি মনে করেন। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ৮৬ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৬০ লাখ শেয়ার হোল্ডার। বাকি ২০ লাখ নতুন সদস্য। বিশাল সংখ্যক সদস্যের প্রায় ৪ শতাংশ পুরুষ সদস্য রয়েছে। বাকিরা নারী। বর্তমানে ব্যাংকের পরিশোধিত ৩০০ কোটি ও অপরিশোধিত ১০০০ কোটি টাকার মূলধন রয়েছে। মাসে এক হাজার থেকে এক হাজার দুই শ’ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ পর্যন্ত কতজন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করেছেন- এমন প্রশ্নে দীর্ঘ দিনের সহকর্মী মহিউদ্দিন বলেন, দেশের ৮৬ লাখ পরিবারের ৪ কোটিরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের উপর নির্ভরশীল। এরা সবাই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তৈরি করা উদ্যোক্তা। 
গ্রামীণ ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা দুর্ভাগ্য। সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে কি করতে চায়-এখনও স্পষ্ট নয়। একদিকে ৯ নারী পরিচালক সরিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে নতুন পরিচালকও দিচ্ছে না। তাহলে কি বোর্ড শূন্য থাকবে? এভাবে চলতে থাকলে দুর্নীতি-অনিয়ম ঢুকে পড়বে। পরে অন্যান্য ব্যাংকের মতো গ্রামীণ ব্যাংকটিও ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হওয়া এক জিনিস। আর শেষ করে দেয়া অন্য জিনিস। বিষয়টি স্পষ্ট নয়। যেহেতু নতুন পরিচালক আসেনি সেহেতু পুরোনোরাই আপদকালীন সময়ে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এছাড়া, মেয়াদ শেষ হলে আর কোন কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবে না, এটি আইনের কোথাও আছে কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
জানা গেছে, গ্রামীণ ব্যাংকের ১২ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে গ্রামীণ দরিদ্র নারী বা গ্রাহকদের প্রতিনিধি ৯ জন। চেয়ারম্যানসহ বাকি ৩ জন সরকার মনোনীত। ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহকদের প্রতিনিধি হিসেবে ৯ জনের মেয়াদ চলতি বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি শেষ হয়েছে। নতুন পরিচালক নির্বাচনের আগ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে নিতে হবে সরকার মনোনীত ৩ সদস্যকেই। সূত্রমতে, নতুন পরিচালক নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত চেয়ারম্যান, অন্য ২ পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন। গ্রামীণ নারীদের প্রতিনিধি পরিচালকরা বলছেন, এতে গ্রামীণ ব্যাংক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দরিদ্র নারীরা ব্যাংকে তাদের প্রতিনিধিত্ব হারাবে। যদিও এতে কোন সমস্যা হবে না বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
গ্রামীণ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে সরকার মনোনীত তিন প্রতিনিধির মধ্যে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক। পরিচালক হিসেবে রয়েছেন পরিসংখ্যান বিভাগের সচিব সুরাইয়া বেগম ও আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার। ঋণগ্রহীতাদের পক্ষে সিলেট অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করছেন মোসাম্মৎ সুলতানা, চট্টগ্রামের মোসাম্মৎ সাজেদা, কুমিল্লার রেহেনা আক্তার ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের তাহসীনা খাতুন। এছাড়া, গাজীপুর অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন সালেহা খাতুন, দিনাজপুরের পারুল বেগম, বগুড়ার মোসাম্মৎ মেরিনা, যশোরের শাহিদা বেগম ও পটুয়াখালীর মোমেলা বেগম।
গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই পরিচালক নির্বাচন করা উচিত। তা না করে সরকার মনোনীত পরিচালকদের দিয়ে ব্যাংক পরিচালনা করা হলে সেখানে দরিদ্র নারীদের প্রতিনিধিত্ব চিরদিনের জন্য হারাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর। বিষয়টি অনেক আগেও বলেছি, কিন্তু সরকার তা শোনেনি।
গত বছরের এপ্রিলে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধিমালা করে সরকার; যেখানে নির্বাচন পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করার পর এ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। পরে আবারও কিছু পরিবর্তন এনে গত বছরের ৩রা নভেম্বর সংশোধিত বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করা হয়। সংশোধিত বিধিমালা অনুযায়ী, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশন গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন পরিচালনা করবে। সংশোধিত বিধিমালা অনুযায়ী, নির্বাচন পরিচালনা কমিশনের অন্য দুই সদস্যের মধ্যে একজন থাকবেন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। অন্যজন আসবেন পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন থেকে। কমিশনার পদে প্রতিষ্ঠানগুলোর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আগের বিধিমালায় গেজেট প্রকাশের ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছিল। সংশোধিত বিধিমালায় তা বাড়িয়ে করা হয়েছে এক বছর। সে অনুযায়ী আগামী ৩রা নভেম্বরের আগেই ৯ পরিচালক নির্বাচন করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.