জীবন যখন জ্বালানি ট্যাংকে

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় দিন দিন শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। ধনী-গরীব কেউই সরকার এবং বিদ্রোহীদের সংঘাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাই যে বাড়িটি সেটি ত্যাগ করাটাই যেন তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকের মধ্যে এই নিয়তির শিকার হয়েছিলেন। এদের মধ্যে আছেন সাঈদ, আনাস এবং বাদি নামের তিন নাগরিক। জীবন বাঁচাতে গিয়ে তাদের কাটাতে হয়েছে জ্বালানি ট্যাংকের ভেতর যাকে মৃত্যুপুরী বলাটা হয়তো ভুল হবে না। ২৪ ঘণ্টা জ্বালানি ট্যাংকের ভেতর কাটানোর সেই মর্মান্তিক কাহিনীটি শোনা যাক সাঈদের মুখে। তিনি বলেন, সিরিয়া থেকে আমি আনাস এবং বাদি তুরস্কে আমরা সাক্ষাৎ করি। আমরা গ্রিস অতিক্রম করতে চাই। কিন্তু তারা আরো দূরে যেতে চায়। আমাদের সবার কাছে থাকা অর্থ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। মাথায় আবার চিন্তাও আছে যে আমাদের পরিবারের সদস্যরা আমাদের ওপর নির্ভর করে আছে। আমরা তাদের জন্য একটি নতুন বাড়ির সন্ধান দেব এই আশায়। এরপর আমরা ইতালি যাওয়ার বুদ্ধি মাথায় আটি। আমরা জানি, জ্বালানি ট্যাংক একটি মৃত্যুপুরী। সেখানকার মানুষগুলোও আমাদের তার ভেতরে ঢুকতে নিষেধ করলো। কিন্তু আমরা গ্রীস অতিক্রম করার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সেটা যেভাবেই হোক। কারণ আমরা এথেন্সে দুই মাস কাটিয়েছি। সেখানে কোনো কাজ ছিল না। বরং নিয়মিত পুলিশের তাড়া খেতে হয়েছে। পাচারকারীরা সব সময় ওত পেতে বসে থাকে। তারা অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যায়। তবে এদের থেকে বাঁচার একটা উপায় আছে। সেটা হলো জ্বালানি ট্যাংকের ভেতর ঢুকে পড়া। অনেক লরিতে দুটি জ্বালানি ট্যাংক থাকে। আমরা একটা ক্যাফের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। এর মধ্যে এক লোককে তার বাচ্চাদের সঙ্গে ইন্টারেনেটে আলাপ করতে দেখলাম। বাচ্চারা তার কাছে জানতে চাচ্ছে, ইতালি কিভাবে আসা যায়। ওই বাবা তার সন্তানকে জানালেন, এখানে গ্রিসের এক লরি চালক আছেন। তাকে জন প্রতি পাঁচ হাজার ইউরো দিলেই হবে। পরে আমরাসহ ইরাকি এক লোককে সঙ্গে নিয়ে শিল্পাঞ্চলের একটি গুদাম ঘরে যাই। লরিটি ওই গুদাম ঘরে রাখা ছিল। চালক গুদাম ঘরের দরজা আটকে দিলেন যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেখানে কি ঘটছে। তিনি ট্যাংকে প্রবেশের আগে সবাইকে টয়লেটের কাজটি সেরে আসতে বললেন। সবাই যেতে চাইলেও আমি না করি। কারণ আমাদের ট্যাংকের এক্সেলের নীচে লুকিয়ে থাকতে হবে। আর এতে আমাদের যে মৃত্যু ঘটবে সেই চিন্তাই মাথায় আসলো। ট্যাংকে প্রবেশের আগে আমরা সবাই আমাদের সন্তানদের জন্য প্রার্থনা করলাম। এরপর প্রবেশ করলাম ট্যাংকে এবং চালক ইঞ্জিন চালু করলেন। প্রবেশ করার পর আনাস চিৎকার শুরু করলো। চালক সেটা শুনতে পেল এবং গুদাম ঘর ত্যাগ করার আগে লরি থামালেন। আনাস বললো, আমি যাব না। আমার সন্তান আছে। আমি মারা গেলে ওদের কি হবে? আমি মরতে চাই না। ইরাকি ছেলেটি ভয়ে চলে গেল। চালক দেখল, তার ৫ হাজার ইউরো লোকসান হচ্ছে। তারপর কপাল খারাপ হলে তাকে হয়তো তিনজনের মৃতদেহ নিয়ে ইতালি যেতে হবে।
তিনি আরও বলেন, চালক আমাদের নিতে অস্বীকার করলেন এবং তারপরও যেতে চাইলে অতিরিক্ত পাঁচশ ইউরো দাবি করে বসলেন। আমরা ট্যাংকের ভেতর প্রবেশ করলাম মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে। পথে বারবারই কেবল সন্তানদের কথা মনে হলো। সময় যেন যেতে চায় না। পথে চালককেও কিছু বলতে পারছি না। এভাবে কেটে গেল ২৪ ঘণ্টা। মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু চালককে ভয়ে কিছু বলতে পারছিলাম না। অবশেষে ইতালিতে পৌঁছালাম। কিন্তু আমরা কোনো কিছু চিনি না। বাদি তার মোবাইলে জিপিএস পদ্ধতি বের করে গ্রাম খুঁজে বের করলো। সেখানকার মানুষগুলো আমাদের সহায়তা করলো। আর তাতেই যেন ফিরে পেলাম হারানো জীবন!
-আলোকিত বাংলাদেশ -বিবিসি

No comments

Powered by Blogger.