কোকোর জানাজায় জনসমুদ্র by মঈন উদ্দিন খান, খালিদ সাইফুল্লাহ ও এম তৌহিদ

রাজধানীতে স্মরণকালের অন্যতম বৃহৎ নামাজে জানাজা শেষে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর লাশ বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। গতকাল দিনটিজুড়েই ছিল শোকের আবহ। গুলশান থেকে বায়তুল মোকাররম, তারপর বনানী কবরস্থান। শোকাতুর মানুষের মিছিল। পুত্রহারা মায়ের কান্নার নির্বাক ধ্বনি। বিকেলের রাজধানী মিশে গিয়েছিল তাই অগণন মানুষের স্রোতে। কোকোর নামাজে জানাজায় ঢল নামে লাখো শোকার্ত মানুষের। এতে সীমানা ছিল তত দূর, চোখ যায় যত দূর। যেন এক জনসমুদ্র। কেউ কেউ একনজর লাশ দেখতে হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। ছিল পুষ্পস্তবক কাঁধে উঁচিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর হৃদয় নিংড়ানো আকুতি। জনতার সমুদ্র স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আরেকটি নামাজে জানাজার কথা। ১৯৮১ সালে সেই জানাজা ছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের।
গত শনিবার দুপুরে আকস্মিকভাবে মালয়েশিয়ায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু হয়। ছোট ছেলের মৃত্যুর খবর বজ্রপাতের মতো আঘাত হানে মায়ের মনে। খালেদা জিয়া হয়ে পড়েন শোকে বিহ্বল। সেই শোকে কেটেছে টানা ৭২ ঘণ্টা। গতকাল ঘড়ির কাঁটায় যখন ১১টা ৪১ মিনিট, ঢাকায় এসে পৌঁছে কোকোর লাশ। বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ হাজারো মানুষের সারি ভেঙে সরাসরি লাশ নিয়ে আসা হয় মায়ের কাছে গুলশান কার্যালয়ে। বেদনাহত মা সাত বছর পরে স্বদেশে ছেলের মরামুখ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অবতারণা হয় এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের। ঘণ্টাখানেক পরে শোকে মুহ্যমান মা ছেলেকে শেষ বিদায় জানালে লাশ নিয়ে আসা হয় বায়তুল মোকাররমে।
জাতীয় মসজিদে এ জানাজার নামাজ ঘিরে নামে জনতার ঢল। দুপুরের পর থেকেই বিএনপি ও শহীদ জিয়ার পরিবারপ্রেমী মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় বায়তুল মোকাররমে। জানাজায় অংশ নিতে ধীর পায়ে জড়ো হাতে থাকে মানুষ। বেলা সাড়ে ৩টার মধ্যে মসজিদ প্রাঙ্গণ ছাপিয়ে চারপাশ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। লাশের জন্য শুরু হয় অপেক্ষা। বেলা ৩টার দিকে লাশবাহী গাড়ি গুলশান থেকে বায়তুল মোকাররমের উদ্দেশে বের হয়। গাড়ির সামনে-পেছনে হাজারো জনতা ঠেলে নামাজে জানাজাস্থলে লাশ আসতে পেরিয়ে যায় প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা। বিজয়নগর পেরিয়ে যখন লাশবাহী গাড়ি বায়তুল মোকাররমের পথ ধরে তখন শোকের মিছিলে রব উঠেÑ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। বিজয় নগর থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের চার দিকে ঠাসা জনতার ভিড় ঠেলে আসতেই সময় লেগে যায় এক ঘণ্টার ওপরে। মসজিদের পশ্চিম গেট দিয়ে প্রবেশ করে কোকোর লাশ। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৫টা ১০ মিনিট। এর আগেই শেষ হয় আসরের নামাজ। নামাজ শেষে অগণিত মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন নামাজে জানাজার অপেক্ষায়। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ জিকির চলে খানিকটা সময়। লাশ পৌঁছার মিনিট দুইয়ের মধ্যেই শুরু হয় জানাজা।
বিকেল ৫টা ১২ মিনিটে কোকোর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন জাতীয় মসজিদের খতিব অধ্যাপক মাওলানা মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন আহমদ। নামাজে জানাজা শেষে মাওলানা সালাহউদ্দিন মুনাজাত পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে আরাফাত রহমান কোকোর রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন। মুনাজাতের সময় মুসল্লিরা আমিন আমিন করতে থাকেন। জানাজার আগে আরাফাত রহমান কোকোর মামা ও বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার মুসল্লিদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। কোকো জীবনে কারো সাথে কোনো ধরনের অপরাধ বা দোষ-ত্রুটি করে থাকলে তা মাফ করে দেয়ার আহ্বান জানান। একই সাথে তার কাছে কোনো পাওনা থাকলে তা জানালে পরিশোধ করা হবে বলে জানান তিনি। জানাজায় অংশ নেয়ায় তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে কোকোর জন্য দোয়া কামনা করেন শামীম এস্কান্দার।
নামাজে জানাজায় মানুষের উপস্থিতি মূল মসজিদের বাইরে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমের রাস্তা ছাপিয়ে যায়। প্রেস কাব থেকে মসজিদের উত্তর গেট হয়ে মতিঝিল সিটি সেন্টার, অন্য দিকে জিরো পয়েন্ট, মসজিদের দক্ষিণ গেট হয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, গুলিস্তান মোড়ে গিয়ে শেষ হয় নামাজে জানাজার কাতার।
জানাজায় আরাফাত রহমান কোকোর আত্মীয়স্বজন ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে অংশ নেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মহাসচিব আবদুল মান্নান, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, ২০ দলীয় জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব:) অলি আহমদ বীরবিক্রম, মহাসচিব ড. রেদওয়ান আহমেদ, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, অধ্যাপক তাসনীম আলম, রিদওয়ান উল্লাহ শাহিদী, মোবারক হুসাইন, ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিসের চেয়ারম্যান অধ্য মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদ আবদুল কাদের, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক, মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান, এনডিপি চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মুর্তজা, ইসলামিক পার্টির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল মোবিন, এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া, জাগপার সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লুৎফর রহমান, লেবার পার্টির মহাসচিব হামদুল্লাহ আল মেহেদি, ডিএলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, মুসলিম লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুল হক মজুমদার, মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী প্রমুখ।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, আলহাজ মোসাদ্দেক আলী, মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন, অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান, মেজর জেনারেল (অব:) রুহুল আলম চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকন, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার, সাবেক এমপি মোজাহার আলী প্রধান, লায়ন হারুনুর রশীদ, অ্যাডভোকেট রফিক শিকদার, যুবদল নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, কৃষক দলের নেতা শাহজাহান মিয়া সম্রাট, জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের সভাপতি মাওলানা আব্দুল মালেক, সাধারণ সম্পাদক মাওলানা নেছারুল হক প্রমুখ।
পেশাজীবীদের মধ্যে ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক রুহুল আমিন গাজী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কবি আবদুল হাই শিকদার, জাতীয় প্রেস কাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, বিএফইউজের সহসভাপতি এম আব্দুল্লাহ, দিগন্ত টিভির উপনির্বাহী পরিচালক মজিবুর রহমান মঞ্জু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, ড. জাহিদুল ইসলাম, বিশিষ্ট আলেম অধ্যাপক মাওলানা কামাল উদ্দিন জাফরী প্রমুখ।
ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) পক্ষ থেকে নামাজে জানাজায় অংশ নেন সভাপতি অধ্যাপক ডা: এ কে এম আজিজুল হক, মহাসচিব অধ্যাপক ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেন, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা: মোস্তাক রহিম স্বপন, সহসভাপতি অধ্যাপক ডা: রফিকুল কবির লাবু, অধ্যাপক ডা: আব্দুল কুদ্দুস, অধ্যাপক ডা: আব্দুস সালাম, প্রথম যুগ্ম মহাসচিব ডা: এস এম রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, ড্যাব বিএসএমএমইউ শাখা সভাপতি ডা: মো: সাইফুল ইসলাম সেলিম প্রমুখ।
জানাজার নামাজ শেষে কত মানুষ হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে। বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের বিপরীতে ৭০ বছর বয়স্ক এক মুরব্বি এ জানাজায় সাথে তুলনা করেন শহীদ জিয়ার জানাজার। তিনি বলেন, কোনো দিন এত মানুষ দেখিনি। এ ছেলের বাবার নামাজে জানাজায় হয়েছিল অনেক মানুষ। জানাজা শেষে মসজিদের দক্ষিণ প্লাজায় আগত মানুষদের লাশ দেখার জন্য সুযোগ দেয়ার কথা থাকলেও প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে সম্ভব হয়নি। সন্ধ্যা ৬টার দিকে লাশবাহী গাড়ি বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও নামে জনতার স্রোত। চোখের জলে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে কোকোর লাশ কবরে নামানো হয়। বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ও কোকোর শ্বশুরবাড়ির দু’জন আত্মীয় কবরে নামান লাশ। এরপর বনানী কবরস্থানের ১৮ নম্বর ব্লকের ১৮৩৮/১৪৭ নম্বর কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় তাকে। বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফনের অনুমতি চাওয়া হলেও দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
দাফনের পর কোকোর রূহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মুনাজাত করা হয়। মুনাজাতে অংশ নেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর, মোসাদ্দেক আলী, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, নাজিম উদ্দিন আলম, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদী। এ ছাড়া ২০ দলীয় জোটের সিনিয়র নেতাকর্মীসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ শেষ মুনাজাতে অংশ নেন।

No comments

Powered by Blogger.