পিতার জানাজার কথা মনে করিয়ে দিলো by আলফাজ আনাম

ঘড়ির কাঁটায় বিকেল ৪টা। তখনো আসরের আজান হয়নি। কিন্তু মানুষ আসছে স্রোতের মতো। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে শেষবিদায় জানাতে মানুষ আসছে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারমের দিকে। এই মসজিদটি যেন হয়ে উঠেছে জাতীয় ঐক্য, সংহতি আর সহমর্মিতার প্রতীক।  মসজিদপানে ছুটে আসা এই মানুষগুলোর চোখে একরাশ বেদনা, হতাশা আর ক্ষোভ। যে মানুষটির জানাজার নামাজে অংশ নিতে তারা এসেছেন সেই মানুষটি দেশে এসেছেন লাশ হয়ে। সাত বছর আগে ওয়ান-ইলেভেনের জবরদখলকারী সরকার তাকে কারারুদ্ধ করেছিল। অসুস্থ অবস্থায় এরপর তাকে থাকতে হয়েছে নির্বাসনে। মায়ের সাথে মাত্র একবার দেখা হয়েছিল বিদেশের মাটিতে। এই মানুষটির মমতাময়ী মা শেষবার দেখতে পারেননি ছেলেকে। মাত্র কয়েক দিন আগেও তাকে কাটাতে হয়েছে অবরুদ্ধ জীবন। এখনো তিনি একরকম অবরুদ্ধই আছেন। সাত বছর পর ছেলের মুখ দেখলেন, চোখ বন্ধ করা অবস্থায়। যে যুবক আর কখনো কথা বলবে না। আর দেখা হবে না। ‘মা’ বলে আর ডাকবে না। অশ্রুসজল চোখে জানালেন শেষবিদায়। কোকোর জানাজার নামাজে অংশ নেয়া অনেক মানুষের মুখে একটি প্রশ্ন ম্যাডাম সামলে উঠতে পারবেন তো! এ যেন শুধু কোকোর জানাজায় অংশ নেয়া নয়। বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সমবেদনা জানাতেও যেন জানাজায় অংশ নেয়া কর্তব্যজ্ঞান করে ছুটে এসেছেন এই লাখো মানুষ। সময় তখন ৪টা ২০। দৈনিক বাংলা মোড় পর্যন্ত মানুষে একাকার। পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যান দিয়ে উত্তর গেটে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু মানুষ আসছে তো আসছেই। শেষ পর্যন্ত প্রিজন ভ্যানটি সরিয়ে নিতে হলো। ৪টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে লোক ছড়িয়ে গেল মতিঝিল শাপলা চত্বরের দিকে পেট্রলপাম্প পর্যন্ত। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন কিছু পুলিশ সদস্য। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ওয়াকিটকি হাতে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলাম ভাই, অন্য দিকে লোক কেমন জানাবেন? ওয়াকিটকিতে সহকর্মীর সাথে কথা বলে জানালেন, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গুলিস্তান মোড় পর্যন্ত লোক হয়েছে। প্রেস ক্লাব পর্যন্ত ভরে গেছে। আরো লোক আসছে। আর ওদিকে বিজয়নগর পানির ট্যাংকি ছাড়িয়ে গেছে। মোটামুটিভাবে বায়তুল মোকাররমের চার পাশের দৃশ্যের একটি বিবরণ পাওয়া গেল। তখনো দাঁড়িয়ে আছি মতিঝিল পেট্রলপাম্পের সামনে। সুশৃঙ্খলভাবে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে মানুষ। ৫টা ১৩ মিনিটে শুরু হলো জানাজার নামাজ। শেষ সালাম ফেরানোর পর মানুষ যাচ্ছেন বাড়ির দিকে। কিন্তু আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো জানাজার পরিধি কত বড় ছিল। অনেক প্রবীণ লোক জানালেন, পিতার জানাজার কথা মনে করে দিলো ছেলের জানাজা। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাজার নামাজেও এভাবেই মানুষের ঢল নেমেছিল। মনে পড়ল গত রাতে সরকারপন্থী এক সাংবাদিকের আক্ষেপ! অবরোধে কোকোর জানাজায় লোক আসতে পারবে না। মানুষ সমবেদনা জানাতে পারবে না। বিএনপির উচিত ছিল অবরোধ তুলে নেয়ার ঘোষণা দেয়া। না, মানুষ অবরোধের মধ্যেই এসেছেন। ক্ষমতাসীনদের নানা মাত্রায় বিষ উদগিরণের মধ্যে মানুষ খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই সাধারণ মানুষের আবেগ আর ভালোবাসাই খালেদা জিয়ার সম্পদ। এই মানুষের ভালোবাসাই পারবে তার শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি জোগাতে।

No comments

Powered by Blogger.