কর্তৃত্ববাদী শাসন মানুষ মেনে নেবে না by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক শক্তি এখন একে অপরের মুখোমুখি। প্রতিদিন চলছে হুমকি-পাল্টা হুমকি। উভয় রাজনৈতিক শক্তি বলছে একে-অপরকে বাংলাদেশের কোথাও জনসভা করতে দেবে না। এরই মধ্যে বিএনপি ঢাকা ও গাজীপুরে তাদের পূর্বনির্ধারিত জনসভা করতে পারেনি। এসব জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে গাজীপুরে খালেদা জিয়ার বক্তৃতা দেয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়। রাজধানীতে তার গুলশানের কার্যালয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে পুলিশ। একটি গণতান্ত্রিক দেশে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী জনসভা করতে পারবেন না, বক্তৃতা দিতে পারবেন না- এটা কি শোভনীয়? এতে কি সরকারের দুর্বলতাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে না?
বিরোধী দলকে স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করতে না দিয়ে সরকার কী স্বার্থ হাসিল করতে চায়, তা জাতির কাছে স্পষ্ট নয়। এর মাধ্যমে তারা যদি ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চায়, তাহলে বলতে হয়, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র প্রিয়। কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসন এদেশের মানুষ মেনে নেয়নি, নেবেও না। তারা যথাসময়ে ফুঁসে উঠবে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাবে। কাজেই এখনও সময় আছে সংশোধন হওয়ার এবং দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার। সেই লক্ষ্যে সরকার সংলাপের দরজা খুলে দিতে পারে, বসতে পারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে। এ একটি কাজে বাংলাদেশ অন্তত ১০ বছর এগিয়ে যাবে। চাঙ্গা হবে দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ। ব্যবসায়ীরা ফিরে পাবেন আস্থা, তাদের ফ্ল্যাট বিক্রি করতে সরকারের দ্বারস্থ হতে হবে না। অন্যদিকে খালেদা জিয়াও সংলাপের জন্য প্রস্তুত। তিনি বারবার সরকারকে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। ২৮ ডিসেম্বরও চীনের রাষ্ট্রদূতকে তার অভিব্যক্তি জানিয়েছেন। তাছাড়া চীনের রাষ্ট্রদূতও আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের তাগিদ দিয়েছেন। আমরা চাই, নতুন বছরের শুরুতেই সংলাপের পরিবেশ তৈরি হোক। মানুষ যাতে নতুন বছরটি কাটাতে পারে স্বস্তির মধ্য দিয়ে।
আমরা লক্ষ্য করছি, সরকার খালেদা জিয়ার সংলাপের আহ্বানকে কোনো গুরুত্ব তো দিচ্ছেই না, উল্টো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে প্রতিনিয়ত বিষোদগার করে যাচ্ছেন। কেউ বলছেন, বিএনপিকে নির্বাসনে পাঠানো হবে; কেউ বলছেন, বিএনপিকে রাজপথে নামতে দেয়া হবে না, খালেদা জিয়াকে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না, বিএনপির সব শীর্ষ নেতাকে নেয়া হবে জেলে ইত্যাদি। ক্ষমতায় থাকলে অনেক কিছু বলা যায়, করা যায়; কিন্তু ক্ষমতা যে চিরস্থায়ী নয় সে ভাবনাও থাকতে হবে। অতীতে আমরা অনেক মন্ত্রীকে দেখেছি বোরকা পরে পালাতে, বস্তিতে আশ্রয় নিতে এবং জীবন ভিক্ষা চাইতে। আমরা দেখেছি আইয়ুব-ইয়াহিয়ার পরিণতি। কাজেই সংযত ভাষায় কথা বলাই সমীচীন, তাতে আখেরে পস্তাতে হয় না।
দেশে যে এতদিন একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করেছে, এর কৃতিত্ব জনগণ ও খালেদা জিয়ার। দেশের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি নেত্রী প্রায় এক বছর কোনো ধরনের উত্তেজনাকর ও সহিংস কর্মসূচি দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন এবং তিনি বারবার সরকারকে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানাচ্ছেন। তার এ আহ্বান অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত। মানুষের মনের অভিব্যক্তিই তার মুখ দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। মানুষ চায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই চলমান রাজনৈতিক সংকটের দ্রুত সমাধান হোক এবং সব দলের অংশগ্রহণে দেশে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।
দৃশ্যত বারবার আহ্বানে এটাই প্রতীয়মান হয়, খালেদা জিয়া বাস্তবিকেই চান দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করুক। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান বিশ্ব একটি তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। এর সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে ছিটকে পড়তে হবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির মূলস্রোত থেকে।
খালেদা জিয়া যদি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরুদ্ধে গত এক বছরে ৫০টি হরতাল ডাকতেন, তাহলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে বর্তমানের চেয়ে খারাপ অবস্থায় নিপতিত হতো। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। তিনি দেশে শান্তি বজায় রাখতে সরকারকে সহায়তা করেছেন।
তবে দেশে যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে, তার স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে সর্বমহলে। কারণ দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক শক্তিকে রাষ্ট্র পরিচালনা প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে দেশে শান্তির ধারাবাহিকতা আশা করা যায় না। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেশে হয়নি। একতরফা ও ভোটবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে সংসদ ও সরকার। এ নির্বাচনে একটি মাত্র ভোট পড়ার আগেই নির্বাচিত হয়ে গেছে পরবর্তী সরকার, যা নির্বাচনী ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। এ নির্বাচনে ভোট দেননি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং প্রধান বিচারপতিসহ দেশের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি। এ নিয়ে মানুষের মাঝে চাপা ক্ষোভও বিরাজমান আছে। সরকারের উচিত মানুষের এ ক্ষোভ আমলে নেয়া এবং দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের পথ সুনিশ্চিত করা। তাতে দূর হবে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট।
সংলাপ-সমঝোতার জন্য বিরোধী জোট অনির্দিষ্টকালের অপেক্ষায় থাকবে- এমনটি মনে করার কারণ নেই। এটি খালেদা জিয়া বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে ব্যক্তও করেছেন। কাজেই চলমান সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের আহ্বানকে দেখতে হবে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে। সংলাপ-সমঝোতার জন্য এগিয়ে আসতে হবে ক্ষমতাসীন দলকে, কারণ তারাই ড্রাইভিং সিটে, তারা রাজনীতিকে যেদিকে নিয়ে যাবেন, রাজনীতি কার্যত সেদিকেই যাবে।
প্রায় বছরজুড়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল শান্ত। রাজপথে বিরোধী দলের তেমন কোনো সহিংস কর্মসূচি ছিল না। এ শান্ত পরিস্থিতি সরকার কাজে লাগায়নি। তারা নির্বিকার থেকেছে, আর পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার কৌশল এঁটেছে। তারা রাষ্ট্রীয় মেশিনারি ব্যবহার করছে বিরোধী দলকে দমন করতে। কিন্তু এর ফল যে রাষ্ট্রের জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার কিছু নমুনা দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে। গুম, খুন ও অপহরণের ঘটনা ঘটছে একের পর এক। এটি চলমান কুশাসনের একটা ফল।
ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে রাজনীতি নিয়ে বিপজ্জনক খেলা শুরু করা হয়েছে। এ খেলার শেষ কোথায় তা কেউ জানে না, কোথাও কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। ধ্বংস ছাড়া এ বিপজ্জনক খেলার পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। পত্রিকায় এসেছে, দেশের অর্থনীতি প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, দেশে কোনো বিদেশী বিনিয়োগ নেই! নেই দেশী বিনিয়োগও! শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি না হওয়ায় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ব্যবসা-বাণিজ্য বলা যায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। কর্মসংস্থানের পথ দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলো ভবিষ্যদ্বাণী করছে।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশের ভয়ানক ক্ষতি করতে পারে। এর আগে কানাডা, জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই কথা বলেছে। তারা এও বলেছে, যত দ্রুত সম্ভব একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। তাতে রাজনীতিতে ফিরে আসবে স্থিতিশীলতা।
এসব কথা ক্ষমতাসীনদের আমলে নিতে হবে। বিপজ্জনক রাজনৈতিক পথ থেকে ফিরে আসতে হবে। সংলাপের আহ্বানে সাড়া দিতে হবে। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, অযাচিত শক্তি প্রয়োগ দুর্বলতার প্রকাশ। এভাবে কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা যায় না। কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে হলে দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে আর সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে সর্বগ্রাসী সংকটের মধ্যে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। এ নির্মোহ সত্যটি শাসক দলকে অনুধাবন করতে হবে দ্রুত।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.