নাশকতার পথ ছেড়ে শান্তির পথে আসুন -প্রধানমন্ত্রী

জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী জোটকে শান্তির পথে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, নাশকতার পথ পরিহার করে শান্তির পথে আসুন। দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কী কী করতে চান তা মানুষকে জানান। নিজের দলকে গড়ে তুলুন। তাহলেই হয়তো ভবিষ্যতে সম্ভাবনা থাকবে। তিনি বলেন, আমরা অসুস্থ রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।  যে রাজনীতি দেশের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য সেই রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। গতকাল সন্ধ্যায় বেতার ও টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচারিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, গত নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেয়াটা রাজনৈতিক ভুল ছিল। তাদের এই রাজনৈতিক ভুলের খেসারত কেন জনগণকে দিতে হবে? বিএনপি নেত্রীকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি- নাশকতা, মানুষ হত্যা, বোমা-গ্রেনেড হামলা, অগ্নিসংযোগ, জানমালের ক্ষতি করা বন্ধ করুন। আপনার ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে আজ আপনি ও আপনার দল সংসদে নেই। আপনি কাকে দোষ দেবেন? আপনার নিজেকেই দোষ দিতে হবে। তিনি বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বানচাল ও যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে বিএনপি-জামায়াত জোট সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা শত শত গাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং ভাঙচুর করেছে হাজার হাজার গাড়ি। আজ ৫ই জানুয়ারি। গত বছরের এই দিনে আপনারা একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে এদেশের জনগণের দল, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে টানা দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য সরকার গঠনের ম্যান্ডেট দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনের আগে আমরা সংলাপে বসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। সংবিধানের আওতায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সব ধরনের ছাড় দিতে চেয়েছিলাম। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে অনির্বাচিত সরকারের কোন ব্যবস্থা নেই। আমাদের শুধু একটাই দাবি ছিল, সংবিধানের মধ্য থেকে আমরা নির্বাচন করতে চাই।  সেখানে যত ধরনের ছাড় দেয়া সম্ভব, তা দিতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম। বিএনপি-জামায়াত জোট চেয়েছিল দেশে একটা অরাজক এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে। অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে  পেছনের দরজা দিয়ে তারা ক্ষমতায় যেতে  চেয়েছিল। কিন্তু দেশের মানুষ তাদের সেই ষড়যন্ত্রের পাতানো ফাঁদে পা দেননি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের সহযোগিতার ফলে উন্নয়নের যে কাজগুলো আমরা শুরু করেছিলাম, তা সমাপ্ত করতে পারছি। পাশাপাশি নতুন নতুন উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার সুযোগ পেয়েছি। তিনি বলেন, আগামী দিনেও যে কোন ধরনের নাশকতা এবং জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখবেন, আপনাদের  কাছে আমি  সেই অনুরোধ করছি। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেন, সামগ্রিক উন্নয়ন, সংবিধান ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত রাখার ক্ষেত্রে ২০১৪ সাল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল বছর। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গত বছর ছিল বাংলাদেশের জন্য সাফল্যের বছর। আমাদের গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের ফলে গত মেয়াদের পাঁচ বছর এবং এই মেয়াদের প্রথম বছরে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশ্বের সামনে রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া পাঁচটি দেশের একটি বাংলাদেশ। আমরা ৬.২ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৬১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। চলতি ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে বাজেটের আকার ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬  কোটি টাকায় বৃদ্ধি করেছি। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের শেষ বছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার যা আজ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,১৯০ মার্কিন ডলারে। ৫ কোটি মানুষ নিম্ন আয়ের স্তর  থেকে মধ্য আয়ের স্তরে উন্নীত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের শেষ বছরে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। আমরা তা কমিয়ে ২৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। ২০০৬ সালে অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.২ শতাংশ। তা এখন কমে ১১ শতাংশে নেমে এসেছে। মানুষের আয় বেড়েছে। কর্মসংস্থান বেড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে আমরা এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করেছি। ২৫ লাখ মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০০৬ সালে রেমিটেন্স আয় ছিল মাত্র ৪.৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে তা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪.২৩ বিলিয়ন ডলারে। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে  বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার। তা আজ ছয়গুণ বেড়ে ২২.৩৯ বিলিয়ন ডলার। ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে  বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল মাত্র ০.৭৯ বিলিয়ন ডলার যা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ৬.৮৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে বাংলাদেশ ছিল খাদ্য ঘাটতির দেশ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ আবারও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ২ কোটি ৭৮ লাখ টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৪৩ হাজার টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সার, সেচ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি বাবদ প্রায় ৪০ হাজার ২৭৮  কোটি টাকার কৃষিসহায়তা প্রদান করা হয়েছে। মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ। আমরা এখন চাল রপ্তানিও শুরু করেছি। তিনি বলেন, এ বছরের পহেলা জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের মাঝে ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৩টি বই বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুরাও ব্রেইল পদ্ধতির বই পাচ্ছে। প্রথম  শ্রেণী থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ১ কোটি ২১ লাখ ৭৮ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি ও উপ-বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করা হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সহকারী শিক্ষকদের পদমর্যাদা ৩য় শ্রেণী থেকে ২য়  শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা ৩য় শ্রেণী  থেকে ২য় শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৬ হাজার ৪৩৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গ্রামের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা  দেয়া হচ্ছে। বিনামূল্যে ৩০ পদের ঔষধ  দেয়া হচ্ছে। ৬ বছরে সাড়ে ১২ হাজারের  বেশি ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ২০০৬ সালে গড় আয়ু ছিল ৬৬.৫ বছর যা এখন  বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ বছর। দেশের প্রায় সব শিশুকে টিকাদান কর্মসূচি এবং সব মানুষকে নিরাপদ পানিপ্রাপ্তি এবং স্যানিটেশনের আওতায় আনা হয়েছে। তিনি বলেন, গত ছয় বছরে আমাদের নিরলস প্রচেষ্টায় ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ২০০ ধরনের ডিজিটাল সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এই খাতের উদ্যোক্তাদের মাসিক আয় ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। বর্তমানে দেশে মোবাইল গ্রাহক ১১ কোটি ৯৭ লাখ। ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৪  কোটি ৩০ লাখ। ২৫ হাজার ওয়েবসাইট নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব পোর্টাল ‘‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’’ চালু করেছে সরকার। আমাদের সরকার নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা’  ঘোষণা করেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।  বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি ৪ মাস থেকে ৬ মাসে বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে এই প্রথম নারীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে।  সরকারি কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ৪০টি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার সেনসিটিভ বাজেট  তৈরি হচ্ছে। আজ নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে সপ্তম অবস্থানে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, সামরিক-অসামরিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন আবারও দ্বিতীয় দফায় বাড়ানো হবে। পদমর্যাদা বৃদ্ধি করে ব্যাপকভাবে পদোন্নতির সুযোগ করে দিয়েছি। জাতির পিতা প্রণীত ১৯৭৪ সালের প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে আর্মড ফোর্সেস গোল- ২০৩০ নির্ধারণ করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীকে অত্যাধুনিক যুদ্ধসরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদকে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয়  শ্রেণীতে এবং ইন্সপেক্টর পদকে দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও সশস্ত্র বাহিনীর ঝুঁকিভাতা বাড়ানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দায়িত্ব নিয়ে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করেছি। যার ফলে দেশে দুর্নীতি অনেক কমে এসেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ ছিল বাক-স্বাধীনতা হরণের দেশ, সাংবাদিক নির্যাতনের দেশ। ১৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০০টি মামলা দায়ের এবং ৭৫০টি হুমকি-হামলার ঘটনা ঘটে। অনেক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। বাংলাদেশে মিডিয়া এখন পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার নতুন ৩২টি  টেলিভিশন, ২২টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলের অনুমোদন দিয়েছে। তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ‘সাংবাদিক সহায়তা ভাতা বা অনুদান নীতিমালা, ২০১২’-এর আওতায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আবারও অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।  যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারী, রাজাকার-আলবদরদের বিচারেরকাজ এগিয়ে চলছে। রায় কার্যকর করা হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ আমরা সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করব। এই বিচার বানচাল করতে, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে অন্ধকারের অপশক্তি যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, জনগণের মঙ্গল চায় না, তারা আবারও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলাম, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করব। ইনশাআল্লাহ তার পূর্বেই আমরা সেটা করতে পারবো। ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছি, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে। এ লক্ষ্য পূরণে সফল হবো। আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই।

No comments

Powered by Blogger.