‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি, বাংলাদেশের নাম’ by কেয়া চৌধুরী

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৩ বছর আগে। মুক্তিযুদ্ধের নানান কষ্ট ও অর্জনগুলো এখনও উঠে আসছে শৈল্পিকতায়।  একাত্তরে যাদের জন্ম হয়নি, তাদের কাছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নির্যাস, অনেক শোকের আবার অনেক শক্তির। চেতনার এই অনুভূতি আমাদেরকে নতুনভাবে আবেগাপ্লুত করে, ক্ষত-বিক্ষত করে আবার জাগ্রত করে দেশাত্মবোধ। শ্যামল সুন্দর বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য বহু রক্তপাত হয়েছে। সম্র্ভম দিতে হয়েছে বাংলার লক্ষ লক্ষ মাকে। দিতে হয়েছে মুক্তিকামী মানুষকে তাজা প্রাণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ৯ মাস যুদ্ধ করেছে বীর বাঙালি।  ইতিহাস পড়ে জেনেছি, আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অসম এক জনযুদ্ধ। ধর্ম ব্যতীত সব ক্ষেত্রে ভিন্ন মানসিকতার পশ্চিম পাকিস্তানি গোষ্ঠী তাদের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী, আধুনিক অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অসহায় বাঙালির ওপর। বাঙালির অস্ত্র ছিল না। প্রশিক্ষণ ছিল না। ছিল না অর্থ। যদিও অপ্রস্তুত বাঙালি জাতির  মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রথম দিকটায় অপরিকল্পিত। কিন্তু একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ সৃষ্টির আকাঙক্ষায় এ দেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরে জেগে উঠেছিল একটি স্বপ্ন, একটি শক্তি। সেই শক্তির আলো ছড়াচ্ছিল। এই আলোর নাম দেশপ্রেম। দেশপ্রেম ও সাহসকে পুঁজি করে, একাত্তরের বাঙালি লড়াকু হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানিরা যুদ্ধের শুরুর দিকে যুদ্ধ-কৌশল হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাবু করতে নারী নির্যাতন শুরু করেছিল। বাংলার নারী শকুনের থাবার শিকার হওয়ার মহা-উৎসব শুরু হয়েছিল। রক্ষা পায়নি শিশু, মধ্যবয়সী কিংবা বৃদ্ধা নারী। এই ন্যক্কারজনক রণকৌশলকে উৎসাহিত করেছিল বাংলার কিছু কুলাঙ্গার। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। সেটি ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামীর মতো সন্ত্রাসী সংগঠন। প্রথম দিকে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িগুলো চিনিয়ে দিয়েছিল। আগুন দিয়ে ছাই করেছিল, মুক্তিযোদ্ধা বা সংগঠকদের বাড়ি। রাজাকার কিংবা আলবদর ও আলশামসদের কখনও মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা বা  সাহস ছিল না। কারণ তারা নিজেরা জানতো, তারা দেশের সঙ্গে, নিজের মায়ের সঙ্গে বেইমানির শেষ-সীমানা অতিক্রম করে ফেলেছে। তাদের মন দুর্বল ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদলেহী হিসেবে নিজেরা শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করতো। সেই শক্তি তারা প্রয়োগ করতো অত্যাচারের মধ্যদিয়ে বাংলার সাধারণ জনগণের ওপর। এই নির্যাতনের ইতিহাস বিশ্বে বিরল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকটা অপরিকল্পিত হলেও ধীরে-ধীরে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের সংগঠিত করে একের পর এক বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল। পাকিস্তানিদের আরোপিত যুদ্ধকে প্রতিহত করতে পেরেছিলেন, দৃঢ়প্রত্যয়ে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, একটি একটি করে পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন ঘটাতে পেরেছিলেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। বিজয় যখন নিশ্চিত, পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করার ঠিক পূর্বমুহূর্তে, আলবদর, আলশামস বাহিনী দেশের প্রায় তিনশত শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও সাংবাদিক, শিল্পী কবি-সাহিত্যিকদের ধরে নিয়ে গেল। বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে; ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ যখন স্থান করে নিচ্ছে তখনই, আমাদের বুদ্বিজীবীদের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে খুঁজে পাওয়া যেতে থাকলো।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা ইতিহাস যখন পাঠ করি, তখন বারবার মনে হয়, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে যোদ্ধারা আমাদের জন্য স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন, যে জীবনের সন্ধান আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন- তার জন্য আমরা সব মুক্তিযোদ্ধার প্রতি কৃতজ্ঞ। তাদের এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। তাদের দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, দেশের তরে বলিদান হওয়ার ইতিহাসকে আমরা কখনও ম্লান হতে দিতে পারি না। হয়তো আমরা একাত্তরের সেই সব বিজয়ী বীরকে এখনও চিনতে পারিনি। কিন্তু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, একাত্তরের বিজয়ী বীরদের একদিন আমরা ঠিকই চিনে নেব। জেনে নেব, তাদের ইতিহাস। উপলব্ধি করবো, তাদের চিন্তা-চেতনাকে। জানা ও চেনার মধ্য দিয়ে তাদের আমরা মূল্যায়ন করবো। ছুঁতে পারবো, তাদের আকাঙক্ষাকে, যে আকাঙক্ষাকে নিয়ে তারা বাংলাদেশকে গড়তে চেয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে, আমরা জেনে গেছি কারা দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তাদের প্রত্যেকের নাম আমাদের জানা। তারা এ দেশেরই মানুষ। দেশমাতৃকার কুলাঙ্গার সন্তান। হয়তো আমাদের সমাজের চেনা মুখ। তবুও দৃঢ়ভাবে বলতে চাই। দেশের সঙ্গে যারা বেইমানি করেছে, বাংলা মাকে যারা অপবিত্র করেছে, আমরা তাদের ঘৃনা করি। ২০১৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ভিন্নমাত্রা নিয়ে আমাদের কাছে ফিরে এসেছে। দীর্ঘ ৪৩ বছর যাবৎ যে শোক বু্‌দ্বিজীবী শহীদ পরিবারগুলো বহন করে আসছিল তা অনেকটা হালকা হয়েছে। বুদ্বিজীবী হত্যাকা-ে আলবদর বাহিনীতে থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের প্রত্যেকে আজ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে স্বীকৃত ও দ-িত। শেখ হাসিনার সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে সুশাসনের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।  স্বাধীনতার গৌরবে ও সৌরভে। যে শোভা মুক্তিযোদ্ধারা ছড়াতে চেয়েছিলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম আরও প্রশস্ত পরিসরে তা ছড়িয়ে দেব। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে। জাতি হিসেবে আমাদের আত্ম পরিচয় এনে দিয়েছেন। আর এর সবকিছুই মূল্য দিতে হয়েছে চড়া দরে, রক্তের বিনিময়ে।
এক সাগরের রক্তের বিনিময়ে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে এসেছেন; আমরা তোমাদের কখনও ভুলব না।
শ্রদ্ধাঞ্জলি, ১৪ই ডিসেম্বরের সব শহীদ বুদ্ধিজীবীর প্রতি।
লেখক : সমাজকর্মী, সংসদ সদস্য।

No comments

Powered by Blogger.