জয় নিশ্চিত না হলে নির্বাচন দেবেন না হাসিনা -ডিএনএ’র মতামত কলাম by ভারত ভূষণ

ঢাকায় বিএনপি’র এক সিনিয়র নেতার লিভিং রুমে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। তখন সে নেতা বললেন, আমি বড়দিন ও নতুন বছরের ছুটি উপভোগ করবো। এরপর সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন শুরু হবে। এ বছরের জানুয়ারিতে ত্রুটিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজপথ লক্ষণীয়ভাবে শান্ত। জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী ১১ মাস ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা আরও সুসংহত করার সময়। চরম বিতর্কিত ওই নির্বাচনে আরও এক মেয়াদে তার ক্ষমতা নিশ্চিত হওয়ার পর বিরোধী দল শুধু সংসদ থেকেই নয়, রাস্তায়ও অনুপস্থিত। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে পশ্চিমা শক্তিগুলো, যারা বিএনপি’কে নির্বাচন বয়কট করতে প্ররোচিত করেছিল, তারা চুপ হয়ে গেছে। কার্যত তারা ক্ষমতার এ পালাবদল নীরবে মেনে নিয়েছেন। গত সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনের আগে, শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র সঙ্গে একটি সংলাপ শুরু করেছিল। তখন বিএনপি নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তে ছিল অটল। সেই সংলাপ ব্যর্থ হয়েছিল। কেননা, বিএনপি দাবি জানিয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পথ খুলে দিতে হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। সংবিধান সংশোধন করে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নীতি বাতিল করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তবে তারা নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চলমান নির্বাচনের প্রক্রিয়ার বিরোধিতা না করলে, বিএনপি’র সঙ্গে আলোচনা করে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তারা দেবে। তবে আন্তর্জাতিক সমর্থনে বলীয়ান বিএনপি তখন তাতে সায় দেয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনে জিতে যায়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে এমন ১৪৭টি আসনের মধ্যে ১৩৯টি আসনেই জয়লাভ করে তারা। একই সঙ্গে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১২৩টি আসনও পায়। এর ফলে ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদে তারা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বিএনপি’র প্রত্যাশা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া আসেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ব্যতিত আন্তর্জাতিক বিরোধিতা থেমে যায়। প্রায় ৪০টির মতো দেশ শেখ হাসিনাকে পুনঃনির্বাচিত হওয়ায় শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা পাঠায়। আর নতুন সংসদের উদ্বোধনী দিনে ঢাকার বেশির ভাগ কূটনীতিক অতিথিদের জন্য বরাদ্দকৃত আসনসমূহ অলঙ্কৃত করেন। হাসিনা এরপর প্রাথমিক আন্তর্জাতিক সমর্থন সতর্কতার সঙ্গে সংহত করেন। বিদেশে তার প্রথম সফর ছিল জাপানে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের অস্থায়ী সদস্যপদের জন্য জাপানের পক্ষে বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন তিনি। এরপরই জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফর করেন। যুক্তরাজ্যেও সফল সফর শেষ করেন হাসিনা। তবে সেটি আনুষ্ঠানিক সফর ছিল না। তিনি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গেও বৈঠক করেন। ক্যামেরন তখন কেবল বাংলাদেশের জন্য সমর্থনের প্রতিশ্রুতিই দেননি, বরং তিনি ঢাকা ও সিলেট সফরের আকাক্সক্ষাও ব্যক্ত করেন। এরপর এ বছরের অক্টোবরে, বাংলাদেশের সংসদের ¯িপকার শিরীন শারমিন কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। একই মাসে আওয়ামী লীগের এক এমপি সারা বিশ্বের ১৬৪টি দেশের পার্লামেন্টের প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি সংগঠন ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ সময়টায় যুক্তরাষ্ট্র একেবারেই চুপ থাকে। এর কারণ হতে পারে, হাসিনার সরকারের প্রতি ভারতীয় সমর্থন। এ সমস্ত প্রাথমিক আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের পর, তার সরকার পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করার আত্মবিশ্বাস পায়। এরফলে জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করা দলগুলোকে নিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রস্তাব অর্থহীন হয়ে যায়। যে বিএনপি এর আগে মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল, তারা এখন আওয়ামী লীগকে নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করছে। যখন সরকার তার অবস্থান সুসংহত করেছে, বিএনপি তখন রীতিমতো বিপর্যস্ত। যদিও বিএনপি’র ভেতরে কিছু পদে বিরোধের পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। তবে দলটির নেতৃত্ব নিয়ে সত্যিকারের মতবিরোধ রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান ও তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী তারেক জিয়া যদিও লন্ডনে স্বেচ্ছানির্বাসনে রয়েছেন, তবুও তাকে দেখা হয় দলের মধ্যে বিভেদকারী শক্তি হিসেবে। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে তারেক জিয়ার উস্কানিমূলক বক্তব্যে তার কোন লাভ হয়নি। তিনি নানা বিতর্কিত কথাবার্তা বলেছেন। যেমন, মুজিবকে বঙ্গবন্ধু না বলে, পাকবন্ধু বলা উচিত এবং পাকিস্তানি নাগরিক হয়েও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য তার মরণোত্তর বিচার হওয়া উচিত। এছাড়া বিএনপি ব্যাপকভাবে এর জোটের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর ওপর নির্ভরশীল, যাদের ক্যাডার ও রাজপথের কর্মীরা বাংলাদেশের সব বড় শহরের রাজপথ অচল করে দিতে পারে। তবে দলটির শীর্ষ নেতারা হয় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সহযোগিতা করার দায়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া ফাঁসির রায়প্রাপ্ত, নতুবা তাদের বিরুদ্ধে করা মামলায় জেল খাটছেন। তাই আগামী জানুয়ারি থেকে বিরোধী দল যদি গণ-আন্দোলন শুরু করে, তাহলে সরকার হয়তো তা সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবে। বাংলাদেশে সরকার তখনই পরিবর্তন হয় যখন সেনাবাহিনী অবস্থান পরিবর্তন করে। আর হাসিনা সেনাবাহিনীকে নিজের পাশেই রেখেছেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে তাদের আরও অন্তর্ভুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করে তিনি এটা করেছেন। শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সেনাবাহিনী ডলারে বেতন পায়। এছাড়া সেনাবাহিনীর চাওয়া মোতাবেক হেলিকপ্টার, সাবমেরিনসহ অন্যান্য অস্ত্র দেয়া হয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনী এখন ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠান, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও পরিচালনা করার অনুমতি পেয়েছে। বর্তমানে দেড় লাখ সদস্যের পুলিশ বাহিনীও খুশি। কেননা, প্রায় ৫০ হাজার নতুন সদস্য নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন হাসিনা। বেসামরিক প্রশাসনকে সন্তুষ্ট রেখেছেন পে-কমিশন ও পদোন্নতি দিয়ে। গণমাধ্যম, বিচারব্যাবস্থা ও সুশীল সমাজকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমকে আয়ত্তে আনা হয়েছে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪ প্রণয়ন করে। অপরদিকে বিচার ব্যাবস্থাকে আনা হয়েছে সম্প্রতি পাস হওয়া একটি সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে, যেখানে একজন বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত ও অভিশংসন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সংসদকে। অপরদিকে সুশীল সমাজকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে এনজিওসমূহের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও অনুগত আমলাদের তা বন্ধ পর্যন্ত করে দেয়ার কর্তৃত্ব দিয়ে। হাসিনার সমর্থকরা তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগসমূহ উড়িয়ে দেন। যদি আজও নির্বাচন হয়, হয়তো বিএনপি-জামায়াত জোট সহজেই জিতে যাবে। তবে শিগগিরই নির্বাচন হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যদি আওয়ামী লীগের সব ভাল ভালয় কেটে যায়, তাহলে আগামী নির্বাচন হবে আগামী ৫ বছর পর। শেখ হাসিনা একজন চতুর রাজনীতিক। আর তিনি নিজের জয় স¤পর্কে নিশ্চিত না হয়ে, নির্বাচনের ডাক দেবেন না।
লেখক পরিচয়: নয়াদিল্লি ভিত্তিক লেখক এবং সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.