মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি আজও

সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাও বদলে যায়। আকার হয় বড়। মহাজোট সরকারের গত আমল থেকে ‘মুক্তিযোদ্ধা সনদ’ ব্যবহার করে চাকরির মেয়াদ বাড়ানো যাচ্ছে। ফলে সনদের গুরুত্ব বেড়ে গেছে অনেক গুণ। এ কারণে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বর্তমান সময় পর্যন্ত অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জন। এরই মধ্যে নতুনভাবে মুক্তিযোদ্ধা হতে আবেদন করেছেন এক লাখ ৩৩ হাজার জন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরও খোঁজ মিলছে। যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত আছেন, তাদেরও নাম-ঠিকানাসহ সনদে ভুলভ্রান্তি রয়েছে। এসব সমস্যা নিরসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করতে আবারও তালিকা যাচাই-বাছাই করছে সরকার। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য, স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও সরকার পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরির কাজ শেষ করতে পারলো না। মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি কবে শেষ হবে এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক মানবজমিনকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরি কবে শেষ হবে সেটা এখনই বলা যাবে না। তবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের এক নতুন তালিকা তৈরি করতে পারবো। যা নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক হবে না। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা কারা, আর কারা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা সেই সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণ করা হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, অনেকেই দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা বলে বা মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন বলে সনদপত্র নিয়েছেন। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা কারা তা সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ছিল না সেহেতু সুযোগটা তারা নিতে পেরেছেন। আগে আমরা সংজ্ঞা ঠিক করবো এবং সংজ্ঞার বাইরে যারা আছেন তাদের আমরা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করবো। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হতে আগ্রহীদের আবেদন যাচাই-বাছাই করতে সারা দেশে উপজেলা ও মহানগর এলাকায় কমিটি করা হয়েছে। এমপিদের নেতৃত্বে ওই কমিটিগুলো তৈরি করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে জমা পড়া ১ লাখ ৩৩ হাজার আবেদন যাচাই বাছাই করবে এ কমিটি। তাঁদেরও যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে হাজির হতে হবে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে এক লাখ ৮০ হাজার গেজেটেড (সনদপ্রাপ্ত) মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। আর নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য যাঁরা আবেদন করেছেন নতুন যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে তাঁদেরও উপস্থিত হতে হবে। বাছাই কমিটি নতুন আবেদনের পাশাপাশি কোন অভিযোগ পেলে লাল মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত তালিকার মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধেও তদন্ত করবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ায় সনদের কদর বেড়ে গেছে। ফলে দিন দিন তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে। এর আগে ২০০১ সালের নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে বিএনপি সরকার। ২০০৩ সাল থেকে সরকারিভাবে তালিকা করে মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট প্রকাশ শুরু হয়। মন্ত্রণালয় গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা দু’টি তালিকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সংরক্ষিত ভারতীয় ভলিউম বুক। এ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন। এর আগে ১৯৮৬-৮৭ সালে এরশাদ সরকার জাতীয় তালিকা প্রণয়ন করে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জনের তালিকা চূড়ান্ত করে। বিএনপি সরকার ভারতীয় ভলিউম বুককে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৯৪ সালে নতুন তালিকা করলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৬ হাজারে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের খসড়া তালিকায় ছিল ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জন। সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬) গেজেটে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯। তবে মহাজোট সরকারের গঠিত জাতীয় কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জন। আর বর্তমান সরকারের তথ্যমতে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জন। নতুন আবেদনের কারণে এ তালিকা আরও বড় হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বড় হওয়া দেশের জন্য কোন শুভ ফল বয়ে আনবে না। বরং নতুন করে কেউ তালিকাভুক্ত হলে বিতর্ক বাড়তেই থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.