লোপাট লাখ লাখ টাকা নেপথ্যে দলীয় কর্মীরা

কোনো প্রকার ইজারা না দিয়ে খাস আদায়ের নামে প্রায় ৪ বছর ধরে লুটপাট চলছে বরিশাল নগরীর ৩টি সিটি টোল গেটে। গত মেয়রের সময় শুরু হওয়া এই পদ্ধতি বহাল রয়েছে এখনও। টোল গেটসংলগ্ন এলাকাগুলোর দলীয় নেতাকর্মীদের পকেট ভারি করার জন্যই যেন দুর্নীতির এই প্রকাশ্য পন্থা। আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র মরহুম শওকত হোসেন হিরনের আমলে এসব গেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল ক্ষমতাসীন দলের দখলে। আর বর্তমান বিএনপি সমর্থিত মেয়র আহসান হাবিব কামালের আমলে নিয়ন্ত্রণ বদল হয়ে তা চলে গেছে তার দলীয় নেতাকর্মীদের হাতে। এসব সিটি টোল গেট দিয়ে নগরীতে প্রবেশ করা সব পণ্যবাহী যানবাহন থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় হলেও তার খুব সামান্যই জমা হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের ফান্ডে। বাকি টাকার পুরোটাই লোপাট করছে গেটের দখলে থাকা দলীয় নেতাকর্মীরা। নগর ভবনের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিখিল চন্দ্র দাস অবশ্য বলেছেন, খুব শিগগিরই এগুলো ইজারা দেয়ার জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হবে। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ যে আসলে নেই তা স্বীকার করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর ভবনেরই হাটবাজার শাখার একাধিক কর্মকর্তা।
মরহুম শওকত হোসেন হিরন মেয়র থাকাকালে ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করেই বরিশাল নগরীর ৩টি প্রবেশ পথে টোল গেট বসায় নগর ভবন। সিটি টোল নামে এই ৩টি গেট থেকে পণ্যবাহী ভারি ও হালকা যানবাহন থেকে শুরু হয় যথাক্রমে ৫০ এবং ৩০ টাকা করে আদায়। শুরু থেকেই কোনো প্রকার ইজারা দেয়া ছাড়াই এসব টাকা সরাসরি আদায় করতে থাকে সিটি কর্পোরেশন। মূলত এই আদায় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। সিটি কর্পোরেশনের একজন করে প্রতিনিধি টোল পয়েন্টগুলোতে থাকলেও বলতে গেলে তিনি থাকেন সাক্ষীগোপাল। সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে নেতাকর্মীদের মাধ্যমে। কোন আইনি প্রক্রিয়ায় এই টোল আদায় শুরু করে নগর ভবন তা নিয়ে অবশ্য বির্তক রয়েছে। এই সংক্রান্ত কোনো বিধি-বিধান যে আজ পর্যন্ত আসেনি তা স্বীকারও করেছেন টোল আদায়সংক্রান্ত বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্ট। হাটবাজার শাখার দায়িত্বে থাকা নুরুল ইসলাম নামের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে এখন পর্যন্ত সিটি টোল গেট পরিচালনাসংক্রান্ত কোনো বিধিমালা আমরা পাইনি।’ বিধিমালা না পেয়ে কি করে আপনারা টোল নিচ্ছেন জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।নগরীর ৩টি প্রবেশ দ্বার ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গড়িয়ার পাড়, বরিশাল-ঝালকাঠি সড়কের কালীজিরা এবং বরিশাল-কুয়াকাটা আন্তঃমহাসড়কের রুপাতলী এলাকায় স্থাপিত এই ৩টি সিটি টোল গেট থেকে ইজারা বাবদ আদায় হওয়া টাকা এবং এর বিপরীতে নগর ভবনের ফান্ডে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ নিয়ে শুরু থেকেই উঠে বির্তক। আদায় হওয়া অর্থের সিকিভাগও সিটি কর্পোরেশন পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠতে থাকে বারবার। কিন্তু সব জেনেও যেন চুপ হয়ে থাকেন কর্মকর্তারা। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে নগর ভবনের এক কর্মকর্তা বলেন, ইজারাবিহীন এই প্রক্রিয়ায় আদায় হওয়া অর্থের প্রায় পুরোটাই যেন নেতাকর্মীদের জন্য বরাদ্দ দিয়ে দেন রাজনৈতিক দল সমর্থিত মেয়র। যে কারণে এই বিষয়ে আর কেউ কিছু বলার সাহস পাননি। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে হারেন শওকত হোসেন হিরন। তার এই পরাজয়ের পরপরই বদলে যায় সিটি টোলের দখলি স্বত্ব। রাতারাতি এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় নবনির্বাচিত মেয়র আহসান হাবিব কামালের দল বিএনপির নেতাকর্মীরা। নেপথ্যে তাদের সঙ্গে থাকেন সিটি কাউন্সিলররাও। মেয়র বদল হওয়ার পর সবাই ভেবেছিল এবার হয়তো টেন্ডারের মাধ্যমে নিয়োগ করা হবে ইজারাদার। বছরের পর বছর ধরে চলা অবৈধ প্রক্রিয়াটিকে করা হবে বৈধ। কিন্তু তেমন কোনো লক্ষ্মণ দেখা যায়নি গত দেড় বছরেও। দখলের হাতবদল ছাড়া আর সবকিছুই চলছে ঠিক আগের মতো। সেই সঙ্গে অব্যাহত রয়েছে লুটপাটের ধারা।নগর ভবনের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গড়িয়ার পাড় এলাকায় থাকা টোল গেট থেকে দৈনিক সর্বোচ্চ ৪/সাড়ে ৪ হাজার টাকা জমা হয় সিটি কর্পোরেশনের ফান্ডে। রুপাতলী থেকে আসে ৮০০ থেকে ১৫শ’। কালীজিরা থেকে ১ হাজার টাকার বেশি জমা হয় না কখনোই। অথচ সরেজমিন এসব স্পটে গিয়ে দেখা গেছে, ৩টি টোল পয়েন্টে দৈনিক আদায়ের পরিমাণ কম করে হলেও ৩৭ থেকে ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩০/৩৩ হাজার টাকাই প্রতিদিন হয়ে যাচ্ছে লোপাট। ধান-চাল কিংবা তরমুজের মৌসুমে যখন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার ট্রাক আসে দক্ষিণে তখন যার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ হাজারে। যদিও মৌসুমের এই প্রকারভেদে কখনোই বাড়ে না নগর ভবনের ফান্ডে জমা হওয়া সিটি টোলের পরিমাণ। বাড়ে কেবল নেতাকর্মীদের পকেটে ঢোকা টাকার অংক। সিটি টোল আদায়ের ৩ পয়েন্টের ৩টিরই খুব কাছে রয়েছে ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের ৩টি শাখা অফিস। সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি এসব অফিসের মাধ্যমে আদায় করা হয় পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা। সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী পণ্যবাহী ট্রাক থেকে এই চাঁদা আদায় করে শ্রমিক নেতারা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একই ট্রাক থেকে সিটি টোলের টাকা উঠলেও দু’পক্ষের আদায়ের হিসাবে থাকে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে রুপাতলীসংলগ্ন দপদপিয়া জিরো পয়েন্টে থাকা শ্রমিক ইউনিয়ন অফিসের এক নেতা বলেন, বর্তমানে ডালসিজন চলছে পরিবহন সেক্টরে। তারপরও প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুইশ’ ট্রাক পার করে এই সড়ক। সেই হিসাবে কেবল ভারি ট্রাক থেকেই সিটি টোল বাবদ আদায় হওয়ার কথা গড়ে ১০ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে ছোট পরিবহন আর স্থানীয় পর্যায়ে থাকা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের পণ্যবাহী যানবাহন তো রয়েছেই। সেখানে যদি সরকারি ফান্ডে দৈনিক মাত্র হাজার/পনেরশ’ টাকা জমা হয় তাহলে সহজেই অনুমেয় যে বাকি টাকা কোথায় যায়।রুপাতলী পয়েন্টের মতোই গণহারে অর্থ লোপাটের তথ্য মেলে গড়িয়ার পাড় আর কালীজিরা পয়েন্টে। গড়িয়ার পাড় পয়েন্টে থাকা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন কার্যালয়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, দৈনিক কম করে হলেও ৪ থেকে ৫শ’ পণ্যবোঝাই যানবাহন ঢোকে বরিশালে। এই মহাসড়ক ধরেই যেহেতু যেতে হয় পটুয়াখালী, ভোলা এবং বরগুনা জেলায় তাই চাপটাও বেশি। এই হিসাব ধরলে সিটি টোল বাবদ আদায় হওয়ার কথা কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা। অথচ এই পয়েন্ট থেকে কখনোই সাড়ে ৪ হাজার টাকার বেশি জমা হয় না নগর ভবনের খাতায়। বরিশাল নগরীতে থাকা প্রতিষ্ঠিত শিল্প গ্রুপ খান সন্স, অপসোনিন, অমৃত লাল দে অ্যান্ড কোং এবং লিভার ব্রাদার্সের ডিপোসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে যানবাহন প্রতি দৈনিক ১ বার সিটি টোল দিতে হয় আমাদের। আর সবগুলো প্রতিষ্ঠানের যৌথ হিসাব করলে কম করে হলেও ১৫০ গাড়ির দৈনিক টোল দিই আমরা। কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যের এই দেড়শ’ গাড়ির টোল বাবদ আদায় হওয়া টাকাও যদি জমা হতো তাহলেও বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি টাকা পেত নগর ভবন। দৈনিক এভাবে প্রায় ৩০ হাজার টাকা লোপাটের সুযোগ করে দিয়ে ৪৩ মাসে নগর ভবনকে হারাতে হয়েছে প্রায় ৪ কোটি টাকা। বৈধ ইজারা পদ্ধতি চালু না করায় যা বাড়ছে প্রতি দিন। অথচ বৈধ ইজারা দিলে হয়তো এভাবে লুটপাটের আর সুযোগ থাকত না। পুরো বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিখিল চন্দ্র দাস বলেন, ‘খাস আদায় পদ্ধতিতে বর্তমানে সিটি টোলের টাকা আদায় হচ্ছে। সেখানে আমাদের লোকজনও আছে। তবে খুব শিগগিরই এগুলো ইজারা দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি আমরা। খাস আদায়ের নামে লুটপাট বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সেরকম কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। অভিযোগ এলে এবং তার প্রমাণ মিললে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.