চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বে- নির্মাণকাজে ভাগ বসায় ছাত্রলীগ by একরামুল হক ও তাসনীম হাসান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৫২ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছে। সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে আরও ১০ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়াও প্রায় শেষের পথে। ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক দুই সাধারণ সম্পাদকের কড়া ‘নজর’ রয়েছে এসব উন্নয়নকাজে। দরপত্র আর ঠিকাদারি কাজ থেকে প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিক সুবিধা নিতেই বারবার বিরোধে জড়াচ্ছে দুই নেতার অনুসারী দুটি পক্ষ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্রলীগের দুই পক্ষের নেতা-কর্মী, পুলিশ ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাম্পাসে যে পক্ষ একচেটিয়া প্রভাব খাটাতে পারে, তারাই সব সুবিধা ভোগ করে। এ নিয়েই একের পর এক সংঘর্ষে জড়াচ্ছে দুই পক্ষ। সর্বশেষ গত রোববার গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ছাত্রলীগের কর্মী তাপস সরকারকে।
ছাত্রলীগের একটি সূত্র বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক দুই সাধারণ সম্পাদকের স্বার্থের দ্বন্দ্বে সংগঠনের বিরোধ মিটছে না। তাঁরা ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশন (চাঁদা) আদায় করছেন। ঠিকাদারি কাজের সাব-কন্ট্রাক্ট (ঠিকাকাজ, তবে জোর করে) ভাগিয়ে নিচ্ছেন।
আর তাঁদের হয়ে সাধারণ কর্মীরা বুঝে না-বুঝে পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। একের পর এক সংঘর্ষের কারণে গত জুন মাসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফ বলেন, এই সরকারের আমলে শতাধিক কোটি টাকার উন্নয়নকাজ হয়েছে। কোটি কোটি টাকার কাজ চলমান আছে। প্রাচীর নির্মাণের জন্য আগামী মাসে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। এসব কাজে অনেকের স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে। স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে দ্বন্দ্ব-বিবাদ যে হচ্ছে না, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে কলা ভবন এবং ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল নির্মাণের কাজ চলছে। এর আগে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে জীববিজ্ঞান অনুষদ ভবন, ছয় কোটি টাকায় জিমনেসিয়াম (ব্যায়ামাগার) ও ১৩ কোটি টাকায় শেখ হাসিনা ছাত্রী হল নির্মাণের কাজ শেষ হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর এসব কাজ শুরু হয়ে। আগামী মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের জন্য আরও ১০ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে।
জেলা পুলিশ সুপার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যাপক উন্নয়নকাজ হচ্ছে। সেখানে চাঁদাবাজি বা কমিশন খাওয়ার ধান্দা যদি হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। আমাদের সহযোগিতা চাইলে পুলিশ চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পিছপা হবে না।’
ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের বিবদমান দুটি পক্ষের একটি হচ্ছে সিএফসি (চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার) ও ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসির হায়দার বাবুল। ভিএক্স (ভার্সিটি এক্সপ্রেস) নামে পরিচিত অন্য পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক সাধারণ সম্পাদক এরশাদ হোসেন ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য মঞ্জুরুল আলম।
ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, মঞ্জুরুল-এরশাদের বাড়ি ক্যাম্পাস থেকে দুই কিলোমিটার দূরে মদনহাটে। আর নাসির হায়দারের বাড়ি ক্যাম্পাস থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে ইসলামিয়া হাট এলাকায়। গত ৫ মে ক্যাম্পাসে ভিএক্স পক্ষের নেতা-কর্মীরা লাঞ্ছিত করেন নাসির হায়দারকে।
এ বিষয়ে সিএফসি ও ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ পক্ষের নেতা ও বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুমন মামুন বলেন, ‘আমরা দেড় বছর ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলাম। ক্যাম্পাসে কোটি কোটি টাকার কাজ কারা করেছে, কী কাজ করেছে, তা-ও জানি না। সিনিয়ররা কী করেছেন, তা-ও আমরা বলতে পারি না।’
ভিএক্স পক্ষের নেতা ও ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির দপ্তর সম্পাদক জালাল আহমেদ বলেন, ‘সিনিয়র ভাইয়েরা কী করেন, তা আমরা জানি না। এসব টেন্ডার-ফেন্ডারের সঙ্গে আমরা জড়িত না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান দুটি নির্মাণ প্রকল্পের একটির ঠিকাদার নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, কাজ শুরুর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা দরপত্র থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন দাবি করেন তাঁর কাছে। কমিশন না দিলে কাজ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। তিনি দাবি করেন, শেষ পর্যন্ত মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে নির্মাণকাজ শুরু করতে হয়। এ জন্য নাসির হায়দার বাবুলকে দায়ী করেন ওই ঠিকাদার। নাসির হায়দার বাবুল ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
তবে নাসির হায়দার বাবুল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের ছেলেরা দেড় বছর ক্যাম্পাসের বাইরে ছিল। আমাদের কোনো ছেলে ঠিকাদার থেকে চাঁদা বা কমিশন দাবি করেনি। মঞ্জুরুল আলম ভাই ও এরশাদ হোসেনের ছেলেরা দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করেন। আগামী মাসে আরও ১০ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হতে পারে। সেই কাজের কমিশনও তাঁরা পকেটে ভরতে চান। তাই আমাদের ছেলেকে খুন করে ক্যাম্পাসে আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে।’
নাসির হায়দার বলেন, তাপস সরকারের খুনিরা চাঁদবাজ-সন্ত্রাসী। তারা ক্যাম্পাসের দরপত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য হত্যাকাণ্ডের মতো এই অপরাধ করেছে।
অভিযোগের বিষয়ে এরশাদ হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে ফোন না ধরায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একপর্যায়ে তিনি মুঠোফোন বন্ধ করে দেন।
মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘শহরে আমার ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। ক্যাম্পাসের ঠিকাদারদের কাছ থেকে আমি কেন চাঁদা বা কমিশন নেব?’ তিনি বলেন, ছাত্রলীগের বিবদমান দুটি পক্ষই তাঁর স্নেহভাজন। সবাইকে মাস খানেক আগে তাঁর বাড়িতে দাওয়াত করেছিলেন। কেবল নাসির হায়দার বাবুল আসেননি।

No comments

Powered by Blogger.