ছদ্মবেশী যোদ্ধা তারামন by মো. সাওরাত হোসেন সোহেল

ছদ্মনাম তারামন বিবি। একটি বীরত্বপূর্ণ নাম। একই সঙ্গে একটি ইতিহাস। জন্ম ১৯৫৭ সালে। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে। বাবা আবদুস সোবাহান, মা কুলসুম বেওয়া। তার এক ছেলে এক মেয়ে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন নানা ভূমিকায়। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য আরও একজন বীর নারী ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পান। তিনি হলেন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম। তারামন বিবি ১১নং সেক্টরে নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুরে ছিলেন। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার প্রস্তাব দেন। প্রথমে তারামনের মা কুলসুম বেওয়া এতে রাজি হননি। পরে মুহিব হাবিলদার তারামনকে ধর্মমেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপরই তারামনকে দশঘরিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে রান্নার কাজে পাঠাতে রাজি হন তার মা। তখন তারামনের বয়স ছিল ১৪ বছর। কিন্তু পরবর্তীতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালানো শেখান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা বর্ণনা করে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার বীর প্রতীক তারামন বিবি বলেন, এছাড়াও দীর্ঘ নয় মাসের অসংখ্য ঘটনার মাঝ থেকে স্মৃতি হাতড়ে জানালেন একদিনের সরাসরি যুদ্ধের ঘটনা। ঘটনা ছিল ঠিক মধ্য দুপুরের। সবাই খেতে বসেছে। তারামনকে পাকিস্তানি সেনাদের কেউ আসছে কিনা তা দেখার জন্য বলা হলো। তারামন সুপারি গাছে উঠে দূরবীন দিয়ে চারদিকে লক্ষ্য রাখছিলেন। হঠাৎ দেখলেন, পাক বাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকে আসছে। সবার খাওয়া বন্ধ। দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে অ্যাকশনের অপেক্ষা করতে লাগলেন সবাই। তারামন তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। সেদিন তারা শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এরপর তারামন অনেক যুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অংশ নেন। অনেকবার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে, তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবার বেঁচে যান। শুধু সম্মুখ যুদ্ধই নয়, নানা কৌশলে শত্রুপক্ষের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর সেজে সোজা চলে গেছেন পাকবাহিনীর শিবিরে। কখনও সারা শরীরে কাদামাটি, চক, কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজেছেন তারামন। চুল এলোমেলো করে বোবা সেজে পাকসেনাদের সামনে দীর্ঘ হাসি কিংবা কান্নার অভিনয় করেছেন। কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো করে চলাফেরা করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে গিয়ে। আবার কলাগাছের ভেলা নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী। জান-মানের কথা না ভেবেই এসব দুঃসাহসী কাজে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য।

No comments

Powered by Blogger.