বাণিজ্যিক লাগেজের ধান্ধায় শত কোটি টাকার বাণিজ্য

শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে নির্বিঘ্নে নির্বিচারে বেরিয়ে আসছে বাণিজ্যিক লাগেজ। এভাবে মাসে শতাধিক কোটি টাকার পণ্য ঢুকে পড়ছে কোনোরকম পরিদর্শন ও ট্যাক্স পরিশোধ ছাড়াই। এতে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির পাশাপাশি পুরো বিমানবন্দর এলাকার জন্য সৃষ্টি হচ্ছে চরম নিরাপত্তাঝুঁকি। পারস্পরিক যোগসাজশের কারণে এসব লাগেজ সঠিক নিয়মে তল্লাশিও করা হয় না।
জানা গেছে, বিমানবন্দর দিয়ে বাণিজ্যিক লাগেজের অধিকাংশ আসছে পাকিস্তান থেকে। এছাড়া থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাইভিত্তিক একটি সিন্ডিকেটও এ কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। নিয়ম অনুযায়ী, বাণিজ্যিক লাগেজ আসার কথা কার্গো টার্মিনাল দিয়ে। সেখানে কাস্টমস পরিদর্শন শেষে ট্যাক্স পরিশোধ করে এসব লাগেজ খালাস দেয়া হয়। কিন্তু পাকিস্তানকেন্দ্রিক একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এসব বাণিজ্যিক পণ্য ট্যাক্স না দিয়ে যাত্রীদের মাধ্যমে ঢাকায় নিয়ে আসে। তারপর কাস্টমসের একটি সিন্ডিকেটকে মোটা অংকের মাসোয়ারা দিয়ে যাত্রী সাজিয়ে লাগেজগুলো পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে।
কাস্টমসের একটি সূত্র জানায়, ডাইরেক্ট পারচেজ বা বিদেশে সরাসরি মূল্য পরিশোধের ভিত্তিতে পণ্য আমদানির অন্তরালে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার মুদ্রা পাচার ও শুল্ক ফাঁকির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ২০০৫ সালে এভাবে ব্যাগেজ আনা বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে ওই সিন্ডিকেট বিদেশী যাত্রী ও কার্গো কোম্পানির মাধ্যমে এই ব্যাগেজ ব্যবসায় নামে। এরপর থেকে যাত্রী সুবিধার কথা বলে তারা অবাধে এই পণ্য খালাস করছে। চক্রটি এতই শক্তিশালী যে অনিয়ম, দুর্নীতি কিংবা ব্যাগেজ বিধিমালা ভঙ্গের অভিযোগে কাস্টমস কিংবা এয়ার ফ্রাইট কর্তৃপক্ষ কোনো যাত্রীকে জরিমানা করলে তারা যাত্রী হয়রানির অভিযোগ তুলে আন্দোলন শুরু করে দেয়। যাত্রীদের মারধর করা, পাসপোর্ট কেড়ে নেয়াসহ নানা অভিযোগ তুলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এসব কারণে সংশ্লিষ্টরা অহেতুক হয়রানির শিকার না হয়ে মালামাল ছেড়ে দেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাণিজ্যিক লাগেজের সঙ্গে আসা অধিকাংশ যাত্রী ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে শতাধিক সুন্দরী নারীও জড়িত রয়েছে। এদের অনেকে প্রতি মাসে গড়ে ১০ বারের বেশি পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় যাতায়াত করে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, বাণিজ্যিক লাগেজ পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন কাস্টমসের একজন বিভাগীয় সহকারী কমিশনার। তার বিরুদ্ধে এ বিষয়ে অসংখ্য গোয়েন্দা রিপোর্টও আছে। জানা গেছে, ১৫টি পাচারকারী গ্র“পের মাধ্যমে প্রতি গ্র“পে ৫ জন করে প্রায় ৭৫ জন এই ব্যাগেজ পণ্য খালাসের সঙ্গে জড়িত। ২২ ডিসেম্বর দুপুরে শাহজালাল বিমানবন্দর কাস্টমস হলের গ্রিন চ্যানেল দিয়ে এ ধরনের একটি বড় ব্যাগেজ চালান পাচারের ঘটনা ঘটে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কাস্টমসের ওই কর্মকর্তার নেতৃত্বে সিন্ডিকেট নামকাওয়াস্তে কাস্টমস রসিদ (বিআর) অথবা একই বিআর বারবার দেখিয়ে লাগেজ পাচার করে থাকে। সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (সিএএবি) ১৫-২০ জনের সংঘবদ্ধ ট্রলিম্যান ও সিকিউরিটি গার্ড, স্ক্যানার মেশিনম্যান এবং বহিরাগত ব্যাগেজ পাচারের গডফাদার ইদ্রিস ও চোরা রহুল পুরো সিন্ডিকেটটি নিয়ন্ত্রণ করছে। ইদ্রিস বিমানবন্দর থানার একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ক্যাশিয়ার (টোল কালেক্টর) বলে জানা গেছে। এদের সহযোগিতা করেন কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) ইয়াকুদ জাহিদ যিনি মাইক-১৫ ওয়াকিটকি ব্যবহার করে থাকেন। কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহের একটি বড় পাচারের ঘটনা গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ জানতে পেরে কাস্টমসকে জানালে ইয়াকুদকে বিমানবন্দর থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে বিমানবন্দরকেন্দ্রিক লাগেজ পাচারের সঙ্গে জড়িত গ্রুপগুলো হল- ঝিনুক গ্রুপ, আলী গ্রুপ, জহির গ্রুপ ও সাঈদ গ্রুপ। জড়িত সিএএবির ট্রলিম্যানরা হল- মান্নান, আনিছ, ইব্রাহিম দেওয়ান ও ফারুক (ইনচার্জ)। পাচারকৃত পণ্যের মধ্যে রয়েছে আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ, সিগারেট, মোবাইল ফোনসেট, মোবাইল এক্সেসরিজ, কাপড়-চোপড় এবং প্রসাধনী সামগ্রী। আবু ইউসুফ নামে কাস্টমসের একজন সহকারী কমিশনার এবং প্রটোকল কর্মকর্তা ইয়াকুদ জাহিদের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় লাগেজপ্রতি ৩০-৪০ হাজার টাকার গোপন চুক্তিতে পাচারের ঘটনা ঘটে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। এর আগে এই পাচারের গডফাদার ছিলেন সাবেক সহকারী কমিশনার ওয়াজেদ আলী। পিকে করাচি ফ্লাইটে এসব পাচারকারীরা কাস্টমসের সঙ্গে মোবাইলে সমঝোতা করে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এদের প্রত্যেকের একাধিক পাসপোর্ট রয়েছে। এরা একাধিকবার ধরাও পড়েছে। কিন্তু পাচার বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। পিকে করাচি ফ্লাইটটি এরা প্রায়ই নিলামে কিনে নেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এরপর ওই ফ্লাইটে তাদের নিজস্ব লোকজনকে ডিউটি দিয়ে ও যাত্রী হিসেবে পাঠিয়ে কমার্শিয়াল লাগেজ পাচার করছে।
এ ব্যাপারে কাস্টমসের সহকারী কমিশনার আবু ইউসুফ জানান, তার শিফটে কোনো ধরনের পাচারের ঘটনা ঘটেনি। প্রটোকলের দায়িত্বে নিয়োজিত সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ইয়াকুদ জাহিদ জানান, পাচার ঘটনা তিনি জানেন না। প্রিভেনটিভ কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছরে এ ধরনের শত শত অভিযোগের প্রমাণ তারা হাতেনাতে পেয়েছে। ব্যাগেজ অনিয়মের অভিযোগে গত এক বছরে প্রায় ২০টি ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা এসব দুর্নীতিবাজের একটি প্রাথমিক তালিকাও তৈরি করেছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যে ২০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে সেগুলো হল- মেসার্স এসএস কার্গো, মেসার্স শাহী ট্রেডার্স, মেসার্স এমএন শিপিং, মেসার্স আরটি এন্টারপ্রাইজ, লিমা এন্টারপ্রাইজ, নাভারন শিপিং লাইন, ট্রেড ওভারসিজ, এমএম ট্রেডার্স, মিলন অ্যান্ড কোম্পানি, প্যান্ডার্স ইন্টারন্যাশনাল, বিজনেস লাইন, এসএম ট্রেডার্স, মডার্ন এজেন্সি, মেসার্স আর কেএল, সুইফ হ্যান্ড লিমিটেড, কালকিনি কমার্শিয়াল, আফতাসিয়া এজেন্সি, একে এন্টারপ্রাইজ, সালাম এন্টারপ্রাইজ। এর মধ্যে এসএস কার্গো লি. শাহী ট্রেডার্স, এমএন শিপিং, আরটি এন্টারপ্রাইজ, এমএম ট্রেডার্স, বিজনেস লাইন, এসএম ট্রেডার্স, মডার্ন এজেন্সির লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু গোপনে মোটা অংকের বিনিময়ে এদের অনেকে আবারও লাইসেন্স ফিরে পেয়েছে। লিমা এন্টারপ্রাইজ, ট্রেড ওভারসিজ, নাভারন শিপিং লাইন, মিলন অ্যান্ড কোম্পানি, প্যান্ডোরা ইন্টারন্যাশনাল হাইকোর্ট থেকে রায় নিয়ে ব্যবসা অব্যাহত রেখেছে। আরকেএল, সুইফ হ্যান্ড, কালকিনি কমার্শিয়াল, আফতাসিয়া, একে এন্টারপ্রাইজ, সালাম এন্টারপ্রাইজকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা করছে। এছাড়া দেশী-বিদেশী কিছু কার্গো কোম্পানিও এই সিন্ডিকেটের সদস্য। এসব কার্গো ক্যারিয়ারের মাধ্যমে বাংলাদেশে মালামাল আসছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ওয়ার্ল্ড কার্গো সার্ভিস (জেদ্দা), মহসিন কার্গো (জেদ্দা), স্কাইলাইন কার্গো (জেদ্দা) ইত্যাদি এয়ার কার্গো (কুয়েত), আল আরাফা কার্গো সার্ভিসেস (জেদ্দা), ঢাকা কার্গো সার্ভিস (জেদ্দা), এস আলম এয়ার কার্গো (কুয়েত), কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার (রিয়াদ), ডোর টু ডোর কার্গো সার্ভিস (জেদ্দা) সম্পর্কে খোঁজ নেয়া শুরু করেছে।
কারা তাদের মালামাল দিচ্ছে, সেগুলো কোথায় যাচ্ছে এ নিয়েও তারা কাজ করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বিমানবন্দরকেন্দ্রিক কিছু কিছু কোম্পানির রয়েছে শক্তিশালী ক্যাডার বাহিনী। কেউ তাদের ওপর খবরদারি করলে এই ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে তাকে শায়েস্তা করা হয়। এজন্য প্রতি মাসে মোটা অংকের মাসোয়ারা পায় ক্যাডাররা। সাধারণ কর্মীরা জানান, এই ক্যাডার বাহিনীর কারণে এ এলাকায় প্রায়ই ছিনতাই, মালামাল লুট, যাত্রী অপহরণসহ বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, ডিওএইচএস, উত্তরা, মগবাজার, মৌচাক, মতিঝিল, গুলিস্তান, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, বসুন্ধরা, সায়েন্স ল্যাব, মিরপুর রোড, মিরপুর, ধানমণ্ডি এলাকার কয়েকশ’ ব্যবসায়ী এই মালামাল আমদানির সঙ্গে জড়িত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এভাবে ব্যাগেজের মাধ্যমে ১ কোটি টাকার পণ্য আনলে তাদের লাভ হয় প্রায় অর্ধকোটি টাকা। আর এলসির মাধ্যমে আনলে লাভ হয় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। এ কারণে বিভিন্ন যাত্রীর মাধ্যমে এরা পণ্য আনা-নেয়া করে।
লাগেজ ব্যবসার নমুনা : প্রবাসী যাত্রীদের ব্যবহার করেই মূলত চক্রটি ব্যাগেজ ব্যবসা পরিচালনা করছে। বেশ কিছুদিন আগে কুয়েত প্রবাসী যাত্রী মন্টু কুয়েতের এস আলম এয়ার কার্গোর মাধ্যমে ৪৯৫ কেজি পণ্য আনলেও তার নিজস্ব পণ্য ছিল মাত্র ২২ কেজি। অতিরিক্ত ৪৭৩ কেজি মালামালের সপক্ষে কোনো কাগজপত্র, আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ছাড়পত্র, মালামালের বিবরণ কিছুই ছিল না। এ কারণে কাস্টমস ওই মালামালের বিপরীতে জরিমানা ধার্য করে। জেদ্দার যাত্রী মোহাম্মদ সিরাজ মিয়া ঢাকা কার্গো সার্ভিসের মাধ্যমে ৪০৮ কেজি ওজনের মূল্যবান জিনিসপত্র আনলেও তার কাগজপত্রের সঙ্গে আনা মালামালের কোনো মিল ছিল না। জেদ্দার মোস্তফা কামাল ওয়ার্ল্ড কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ২০০ কেজি মালামাল আনলেও সেখানে তার নিজস্ব মালামাল ছিল ৫৩ কেজি। আবদুল জব্বার জেদ্দার মহসিন কার্গোর মাধ্যমে ৪৯০ কেজি মালামাল আনলেও তার নিজস্ব পণ্য ছিল ৮৬ কেজি। মোহাম্মদ দুদু মিয়া জেদ্দার স্কাইলাইন কার্গো এজেন্সির মাধ্যমে ৪৪৩ কেজি আনলেও নিজের ছিল মাত্র ৪৩ কেজি। কুয়েতের রেজওয়ানা কামাল মোস্তফা ইত্যাদি এয়ার কার্গোর মাধ্যমে ৫০৩ কেজি পণ্য আনলেও তার নিজস্ব মাত্র ৮৩ কেজি। মনির হোসেন কুয়েতের আল আরাফা কার্গো সার্ভিসের মাধ্যমে ২৩০ কেজি মালামাল আনেন, যার মধ্যে নিজস্ব মাত্র ২৯ কেজি। রিয়াদের যাত্রী শহীদ হোসেন কন্টিনেন্টাল কুরিয়ারের মাধ্যমে ৪৯৮ কেজি মালামাল ঢাকায় আনে। এর মধ্যে তার নিজস্ব মালামাল ছিল ৭৫ কেজি।
সিএন্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের নেতা মিজানুর রহমান বলেন, কোনো প্রবাসী যাত্রীর মালামাল ছাড়ানোর জন্য সিএন্ডএফ কাজ করে না। তবে যাত্রীর মালামাল যদি কার্গোতে আসে সেক্ষেত্রে সিএন্ডএফ এজেন্ট লাগবেই। এজন্য যাত্রীকে অবশ্যই তার পাসপোর্টের কপি, মালামালের তালিকা, পণ্য পরিবহন চালান, এয়ারওয়ে বিল, ডিক্লারেশন ফরম দিতে হয়। এগুলো পাওয়ার পর সিএন্ডএফ এজেন্ট ওই পণ্য খালাস করে দেয়। কিন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মালামাল নিয়ে সন্দেহ হলে ব্যাগেজের ক্ষেত্রে যাত্রীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে থাকেন। তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে যদি কোন দুর্নীতি হয় আর সরকার যদি তাদের কাছে সহায়তা চায় তাহলে তারা দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করে বিচারের ব্যবস্থা করবেন।

No comments

Powered by Blogger.