তৃণমূল আলীগের নেতৃত্বে বিতর্কিতরা

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপক্ষা করে তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্থান দেয়া হচ্ছে বিতর্কিতদের। সেই সঙ্গে বাদ পড়ছেন ত্যাগী নেতারা। ইতিমধ্যেই ২২টি সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি এসব জেলার উপজেলা ও পৌর শাখার সম্মেলন শেষ করে গঠন করা হয়েছে নতুন কমিটি। নবগঠিত অনেকগুলো কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে স্থান পেয়েছে বিতর্কিতরা। এমনকি হত্যা মামলার আসামি থেকে শুরু করে মাদকসেবী, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, গণফোরাম ও জাকের পার্টি করে আসা ব্যক্তিরাও ঠাঁই পেয়েছেন এই দুই পদে।
মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপিদের ‘ম্যানেজ’ করে পদগুলো বাগিয়ে নিয়েছেন তারা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চাপা ক্ষোভ ও হতাশা। এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়া হলে দলীয় কার্যক্রমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে উল্লেখিত সব তথ্য। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সড়ক পরিবহন এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, কমিটি পাঠালেই তা অনুমোদন দেয়া হবে না। সব কমিটিই কেন্দ্রীয়ভাবে যাচাই-বাছাই করা হবে। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এসব কমিটি দেখবেন। ‘এ টু জেড’ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আলোচনা হবে। তারপর কমিটি অনুমোদন দেয়া হবে। সেখানে যদি বিতর্কিতরা থাকেন অবশ্যই তারা বাদ পড়বেন।
ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, তৃণমূলের বিভিন্ন কমিটিতে বিতর্কিতদের স্থান দেয়ায় মন্ত্রী-এমপিদের ওপর ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় কার্যালয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ জমা হচ্ছে। শুক্রবার অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপজেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপিসহ বিতর্কিতদের দায়িত্ব না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
সেপ্টেম্বর থেকে বিপুল সমারোহে তৃণমূল আওয়ামী লীগের সম্মেলন শুরু হয়েছে। এজন্য কেন্দ্রীয়ভাবে দশটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। ইতিমধ্যে ২২টি জেলায় সম্মেলন শেষ হয়েছে। রাজশাহী-১ আসনের কাকনহাট পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয়েছে আবদুল মজিদ মাস্টারকে। তিনি গোদাগাড়ী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ছিলেন। এই ব্যক্তি সরকারদলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন এমপি প্রভাব বিস্তার করে তাকে নেতৃত্বে এনেছেন। রাজশাহীর বাগমারায় স্থানীয় এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য আগে থেকেই সমালোচিত। হঠাৎ করে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর এবার দলীয় নেতৃত্ব কব্জা করেছেন। তিনি বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, প্রবীণ নেতা আবদুস সোবহান চৌধুরীকে বিতাড়িত করে ওই পদটি নিজেই দখল করেছেন। এ নিয়ে সেখানে সমালোচনার ঝড় বইছে।
রাজশাহীর আরেক এমপি গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ দ্বারা কখনোই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তিনিও ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের মতো হঠাৎ উড়ে এসে নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন। এবার তিনি নিজ উপজেলা পুঠিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতির পদটি দখল করছেন। তার চেষ্টা এখন জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ দুই পদের একটি দখল। এ সংসদ সদস্য সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে নিজের ইচ্ছা পোষণ করেছেন বলে জানা গেছে। রাজশাহীর স্থানীয় আরেক এমপি, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম নিজ উপজেলা বাঘা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছেন। তারও লক্ষ্য রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বে আসা। প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা এমন তথ্য জানিয়েছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য গোলাম রাব্বানী। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গণফোরাম থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তিনি ভোটারবিহীন নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে জাসদ এবং জাকের পার্টি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে এ ব্যক্তির। এবার তিনি শিবগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি পদটি দখলে নিয়েছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলায় প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা হুমায়ুন রেজাকে সরিয়ে সভাপতি হয়েছেন শাহজাহান আনসারী। তিনি বিএনপি ও জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন মামুনুর রশিদ। তিনি এক সময় জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মামুন আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের ফুফাতো ভাই। অপরজন এমপির ঘনিষ্ঠ।
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান। তিনি দুবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন। মিজানুর রহমান স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল কুদ্দুসের ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচিত। অথচ ত্যাগী নেতা হিসেবে পরিচিত জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আরিফুর রহমান আরিফ চেষ্টা করেও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসতে পারেননি।নাটোর বনপাড়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছেন কেএম জাকির হোসেন। তিনি বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবু হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি। জাকিরও সরকারদলীয় স্থানীয় এমপির লোক হিসেবে পরিচিত। বনপাড়া পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন আতাউর রহমান আতা। এলাকায় তার পরিচিতি একজন মাদকসেবী হিসেবে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, আতাউর রহমান আতাকে প্রায় সময় অসংলগ্ন (মাতাল) অবস্থায় দেখেন সেখানকার মানুষ।
প্রভাব বিস্তার করে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন স্থানীয় সংসদ সদস্য তানভির ইমাম। শুক্রবার অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরপরই তিনি নতুন পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আগে এ পদে ছিলেন সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম। গত নির্বাচনে তাকে বাদ দিয়ে তানভির ইমামকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ দখল করেছেন স্থানীয় এমপি আবদুল মজিদ মণ্ডল। গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও বিপুল অর্থবিত্তের মালিক মজিদ মণ্ডল ভোটারবিহীন নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কখনোই যুক্ত ছিলেন না।
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদটি বাগিয়ে নিয়েছেন স্থানীয় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। ওয়ান-ইলেভেনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রতন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। এবার স্থানীয় ত্যাগী নেতা মনিন্দ্র চন্দ্রকে বিতাড়িত করে সভাপতি পদ দখলে নিয়েছেন। ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন মোহাম্মদ আলী। তিনি স্থানীয় এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দবিরুল ইসলামের ছোট ভাই। দলে সক্রিয় না থাকলেও ভাইয়ের আশীর্বাদে এ পদটি দখল করেছেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ।
সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন মোশারুল ইসলাম। তিনি সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের আশীর্বাদপুষ্ট বলে জানা গেছে। রমেশ চন্দ্র সেন মন্ত্রী থাকাকালে মোশারুল ইসলাম বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাবেক মন্ত্রীর প্রভাবেই উপজেলা আওয়ামী লীগের পদটি দখলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন সিরাজ যুগান্তরকে বলেন, গঠনতন্ত্র মেনেই সব উপজেলায় কাউন্সিল হচ্ছে। কোথাও বিতর্কিত ব্যক্তিদের দলে ঠাঁই হচ্ছে না। রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, যদি এমন ঘটনা ঘটেই থাকে তা হবে দুঃখজনক। অভিযোগ এলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.