শিশুর চোখে জল, হাতে হাতকড়া by মজিবর রহমান খান

পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে গেঞ্জি। ডান হাতে ব্যাগ নিয়ে পুলিশ পাহারায় এগিয়ে চলেছে এক শিশু। শিশুটির হাতে হাতকড়া, আর দুই চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে গালে। ওর হাতকড়ার সঙ্গে বাঁধা আরেক কিশোরের হাত। হাতকড়ার রশিটি পুলিশের হাতে ধরা। গতকাল বুধবার দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের আদালত চত্বরে মো. শামীম (১৫) নামের এক শিশুকে পুলিশ পাহারায় এভাবেই হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মানবাধিকারকর্মীদের দাবি, শিশুর সঙ্গে এমন আচরণ শিশু অধিকার সনদ ও আইনের সুনির্দিষ্ট লঙ্ঘন। শিশু শামীমের বাবা মো. মুসার দাবি, পুলিশ শামীমের বয়স ১৫ দেখালেও আসলে তার বয়স ১৩। ২০১৩ সালের শিশু আইনে উল্লেখ আছে, নয় বছরের কম বয়সী শিশুকে কোনো অবস্থাতেই গ্রেপ্তার বা আটক করা যাবে না। নয় বছরের ওপরে কোনো শিশুকে গ্রেপ্তার করার পর তাকে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি লাগানো যাবে না।

ওই শিশুর পরিবার ও আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার মজিবর রহমানের প্রতিবন্ধী ছেলে শরিফুলের ঝুলন্ত লাশ হরিপুর বাজারের একটি দোকান থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। ৫ আগস্ট শরিফুলের ভাই মনিরুল ইসলাম হরিপুর বাগানবাড়ি গ্রামের মুসার ছেলে মো. শামীম (১৫) ও খোরশেদ আলীর ছেলে মো. শামীমের (১৯) বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। পরদিন পুলিশ দুই শামীমকেই গ্রেপ্তার করে। সেদিনই উপপরিদর্শক (এসআই) নির্মল চন্দ্র তাদের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাদের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের ১৫ দিন পর তাদের যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
তবে যশোরে পাঠানোর সময় তাদের পরিবারকে জানানো হয়নি বলে বড় শামীমের বোন দিলারা বেগম অভিযোগ করেন। দিলারা বলেন, ‘জেলখানায় দেখা করতে এসে শুনি দুজনকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোথায় পাঠানো হয়েছে তা তারা জানায়নি।’ পরে আদালতে হাজিরার জন্য দুই শামীমকে গত সোমবার যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে আনা হয়। আদালত প্রাঙ্গণে শিশু শামীম জানায়, যশোর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে আনার সময় তাদের হাতকড়া পরিয়ে আনা হয়েছে। হাজিরার পর গতকাল দুপুরে তাদের আবার পুলিশ পাহারায় হাতকড়া পরিয়ে যশোর নিয়ে যাওয়া হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন ঠাকুরগাঁওয়ের সাধারণ সম্পাদক মো. সাহাবুদ্দীর খান জানান, জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রসমূহ শিশুদের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অবহেলা, শোষণ, দুর্ব্যবহার, নির্যাতন বা অন্য কোনো নৃশংস, অমানবিক বা অমর্যাদাকর আচরণ বা শাস্তির শিকার সব শিশুর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা ও দ্রুত সমাজে তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ঠাকুরগাঁওয়ের মানবাধিকারকর্মী নার্গিস চৌধুরী জানান, শুধু আইন করেই শিশুদের অধিকার রক্ষা করা যাবে না। আত্মসম্মান ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এমন আচরণ না করে, তাদের সংশোধনের সুযোগ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। এ ব্যাপারে এসআই নির্মল চন্দ্র বলেন, ‘তাদের এভাবে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে আনা হয়েছে, সেটি আমি জানি না। বর্তমানে আমি প্রশিক্ষণে আছি।’

No comments

Powered by Blogger.