স্মৃতিতে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন by শামসুল হুদা

ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন- একটা নাম, একটা ইতিহাস। চলে গেলেন না ফেরার দেশে গত ৮ অক্টোবর। ১৯৪৮-৫০ সালে ঢাকা কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্রলীগের ঢাকা কলেজ শাখার প্রতিনিধিত্ব করার সময় থেকে মতিন ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। এরপর ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর ছাত্রনেতা হিসেবে ভাষা আন্দোলনের সব কর্মসূচি, সভা-মিছিলে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে আমরা ঘনিষ্ঠ হই। তখন মতিন ভাইকে দেখেছি ভাষা আন্দোলনে আপসহীন নেতা হিসেবে। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। তৎকালীন সরকার চিঠির খাম, চিঠির কার্ড, মানি অর্ডার ফরম, স্ট্যাম্প ইত্যাদিতে বাংলা বাদ দিয়ে কেবল উর্দু ভাষা ব্যবহার করা শুরু করলে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় আবদুল মতিন এতে সোচ্চার হয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে  প্রতিষ্ঠিত করার শপথ গ্রহণ করেন।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় এবং কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তখন আমাদের ছাত্রসমাজের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল এবং আবদুল মতিন এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠিত হয়েছিল। তা দিন দিন যখন অকার্যকর হয়ে পড়ে তখন দল-মত নির্বিশেষে ছাত্রদের একটি সভায় সক্রিয়ভাবে আন্দোলন পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় এবং মতিন সাহেব এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে যে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল তিনি তার  অন্যতম সদস্য হন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকায় এসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করে বলেছিলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। ফলে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সফল ধর্মঘট পালন শেষে মতিন সাহেবের নেতৃত্বে ছাত্রদের পক্ষ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী তীব্রতর আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। সরকার আমাদের আন্দোলন বানচাল করার উদ্দেশ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। এতে ছাত্রসমাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। ১৪৪ ধারা অমান্য করার ব্যাপারে ছাত্রদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়। বেশির ভাগ ছাত্রনেতা অমান্য করার বিপক্ষে ভোট দেন; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সপক্ষে অটল ছিলেন এবং সাধারণ ছাত্ররা তাকে সমর্থন দিয়ে ১৪৪ ধারা অমান্যের পক্ষে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। গাজীউল হককে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কলা ভবনের সমাবেশে সভাপতি নির্বাচন করে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা করে দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে। পুলিশি হামলার শিকার হয়ে হাবিবুর রহমান (উত্তরকালে প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান) এবং এস এম হলের ভিপি শামসুল হক (পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত)সহ আমাদের অনেককেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে রফিক, জব্বার, সালাম ও বরকতসহ আরো অনেকে শহীদ হন। মতিন সাহেবের নেতৃত্বে আমরা সে দিন ১৪৪ ধারা অমান্য করার এ সিদ্ধান্ত না নিলে হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো এ দেশের ইতিহাস। তাই বলা যায়, ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন কার্যকর না হলে হয়তো বাংলা রাষ্ট্রভাষা হতো না। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন অনিশ্চিত ও কঠিন হয়ে যেত। প্রত্যেক জাতির জীবনে ইতিহাস এক অমূল্য সম্পদ। এ অমূল্য সম্পদের সৃষ্টি হয়ে থাকে কোনো এক দুর্লভ মুহূর্তকে কেন্দ্র করে। একুশে ফেব্রুয়ারি তেমন এক দুর্লভ মুহূর্ত, যার ফলে এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এ মহান একুশের-ই সুবর্ণ ফসল।
আবদুল মতিন তার চোখের কর্নিয়া অন্ধজনের আলোর জন্য সন্ধানীকে এবং দেহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য দান করে গেছেন। শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, বামপন্থী রাজনীতিবিদ হিসেবে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক চর্চায়ও কমরেড আবদুল মতিনের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, আত্মত্যাগী ও নির্লোভ মানুষ। তিনি আজীবন সাধারণভাবে জীবন যাপন করে গেছেন। কোনোরূপ লোভ-লালসা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ভাষা আন্দোলনে আবদুল মতিনের অবদান চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক -শামসুল হুদা: ভাষাসৈনিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত

No comments

Powered by Blogger.