না জানার দোষ-গুণ by সাযযাদ কাদির

জাকারিয়া শিরাজী, আমাদের জ্যাক ভাই, আজ নেই, ভাবছি তিনি থাকলে কি বলতেন! প্রতি বছর, সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ ঘোষণার আগের রাত ১১-০০টার দিকে, ফোন করে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন সম্ভাব্য বিজয়ী সম্পর্কে। প্রথমে নামটি বলতেন, তারপর বলতেন, ‘কাল এই নামটি দেখবেন পত্রিকায়।’ আমাকেও বলতেন ভবিষ্যদ্বাণী করতে। নানা কথা বলে সে বিপদ এড়াতে হতো তখন। জ্যাক ভাই সব সময়ই বলতেন ঔপন্যাসিকদের নাম, এ প্রশ্নে প্রায়ই দ্বিমত হতো তাঁর সঙ্গে। মনে আছে ২০০৫ সালে তিনি বলেছিলেন ইংরেজ ঔপন্যাসিক জন ফাউলস-এর নাম। এর কিছু আগে থেকে ফাউলস-এর ‘দ্য ম্যাগাস’ (১৯৬৫) ও “দ্য ফ্রেঞ্চ লেফটেন্যান্ট’স উয়োম্যান” সম্পর্কে বলছিলেন জ্যাক ভাই, কবি কায়সুল হক সম্পাদিত ‘শৈলী’তে কিছু লিখেছিলেনও সম্ভবত। সে রাতে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি সর্বান্তঃকরণে আস্থা জানিয়েছিলাম আমি। কারণ ফাউলস-এর নভেলেট ও ছোটগল্প সঙ্কলন ‘দি এবোনি টাওয়ার’ আমার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলোর একটি। পরদিন নাম ঘোষণা হলো বৃটিশ নাট্যকার হ্যারল্ড পিনটার-এর। মাসখানেক পরে, ৫ই নভেম্বর, মারা গেলেন জন ফাউলস। জ্যাক ভাইকে বললাম, আন্তন চেখভ, তলস্তয়, জেমস জয়েস, ভারজিনিয়া উলফ, আরথার মিলার, ভ্লাদিমির নবোকভ, গ্রাহাম গ্রিন, হরহে লুই বরহেস সহ অনেকেই পান নি নোবেল। তিনি বললেন, হ্যাঁ। তারপর এক দীর্ঘ তালিকা দিয়ে বললেন, এঁরাও পান নি। আরও বললেন, চারচিল পেলে মাও চ’তোং পাবেন না কেন? গত ২২শে জানুয়ারি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন জ্যাক ভাই। তাঁর বিদায়ের সঙ্গে-সঙ্গে আমার জন্যও বন্ধ হয়ে গেছে বিশ্ববাতায়নের উদার উন্মুক্ততা। তাঁর মাধ্যমেই পরিচিত হয়েছি আমেরিকান ঔপন্যাসিক করম্যাক ম্যাককারথি (‘ব্লাড মেরিডিয়ান’, ‘নো কানট্রি ফর ওল্ড মেন’), ডন ডিলিলো (‘হোয়াইট নয়েজ’, ‘লিবরা’), টমাস পিনচন (“গ্র্যাভিটি’স রেইনবো”, ‘মেসন অ্যান্ড ডিকসন’) প্রমুখের সঙ্গে। এঁরা সবাই নোবেল পেতে পারেন বলে জ্যাক ভাইয়ের মতো আমিও বিশ্বাস করি দৃঢ়ভাবে। তবে অজ্ঞাতদের প্রতি বিশেষ ঝোঁক থাকায় যোগ্যতায় উঁচুতে অবস্থান করলেও অনেকের দিকে তাকায় না নোবেল কমিটি। এবার জাঁ পাতরিক মোদিয়ানো’র নোবেল প্রাপ্তিতে এ সব বিষয় নিয়েই ঘুরেফিরে আলোচনা হচ্ছে বিশ্বসাহিত্য-মহলে। অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করছেন আমেরিকান ঔপন্যাসিক ফিলিপ রথ, বৃটিশ ঔপন্যাসিক সলমান রুশদি, কানাডিয়ান কবি-ঔপন্যাসিক মারগারেট অ্যাটউড, চেক লেখক মিলান কুনদেরা, জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি কবে বা আদৌ পাবেন কিনা নোবেল। জ্যাক ভাই আজ থাকলে জিজ্ঞেস করতেন, জানেন নাকি পাতরিক মোদিয়ানো  এবার নোবেল পেলেন সাহিত্যে? হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করতাম, কে? জ্যাক ভাই বলতেন, ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার প্রতিক্রিয়া যথার্থ হয়েছে, কারণ আপনি ফরাসি নন। অবশ্য ফরাসি হলেও যে তাঁকে সঙ্গে-সঙ্গে চিনে ফেলতেন - তা-ও নয়।
তা উনি ঔপন্যাসিক নাকি? আপনি তো আবার ঔপন্যাসিকদেরই নোবেল পাওয়া সমর্থন করেন!
মানে... মোদিয়ানো তো চিত্রনাট্য লেখেন, বাচ্চাদের বই লেখেন। তবে হ্যাঁ, উপন্যাসের জন্যই তাঁর পরিচয় বেশি। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘মিসিং পারসন’ (১৯৭৮)। সেটা এক গোয়েন্দা কাহিনী।  ইংরেজিতে মাত্র কয়েকটি বই অনুবাদ হয়েছে তাঁর, এর মধ্যে ওটাও হয়েছে।
তাহলে তার অবদান, কীর্তি?
নোবেল কমিটি বলেছে, মোদিয়ানো পুরস্কার পেয়েছেন ‘সেই স্মৃতিশিল্পের জন্য যা দিয়ে তিনি জাগিয়ে তোলেন সবচেয়ে ধারণাতীত মানবিক নিয়তি এবং অধিকৃত জীবনবিশ্বের উদঘাটন’।
অধিকৃত... মানে নাৎসি অধিকৃত প্যারিস, ফ্রান্স নাকি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বুঝেছেন! দখলমুক্ত হওয়ার ক’ সপ্তাহ আগে মোদিয়ানো’র জন্ম হয় প্যারিসে। ওর বাবা ইহুদি, চোরাকারবারি... সম্ভবত জার্মান গেসটাপোদের সহযোগী। মোদিয়ানো’র অনেক লেখায় পাবেন নাৎসি অধিকৃত জীবনের নানা জটিলতা ও আপসমুখিতার কথা। তাঁবেদার ভিশি সরকারের আমল সম্পর্কে একালে যে ব্যাপক বিস্মৃতি... মোটামুটি সেটাই তাঁর বিষয়।
এই তো বেশ নোবেল-নোবেল ব্যাপার...!
আসল কথা তিনি ফরাসি। এ পর্যন্ত ১৫ জন ফরাসি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক হলেন তাঁকে নিয়ে।
কোনও যোগসাজশ নেই তো?
মনে হয় না। ‘তিরিশ বছরের যুদ্ধ’ (১৬১৮-১৬৪৮)-এর পর থেকে সুইডেনের সঙ্গে ফ্রান্সের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল, তবে এখন তো দু’জনই বলছে ‘ও সব অতীতের ব্যাপার’। তাহলেও একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার নিয়ে খোঁচাখুঁচি করার মতো সম্পর্ক যে নেই তা বলা যায় নিঃসন্দেহে। আহা, অর্থনীতির নোবেল-ও তো গেল ফ্রান্সের ঘরে।
মোদিয়ানো এখন কি করবেন?
এই ১.১ মিলিয়ন পাউন্ড পুরস্কার আরও ধনী করেছে তাঁকে। এখন থেকে কর দেবেন আগের চেয়ে বেশি। তারপর তাঁর যা অভ্যাস... মিডিয়া যেমন এড়িয়ে চলেন তেমনই চলবেন।
তাহলে আমি যে তাঁর নাম জানতাম না, এতে দোষ হয় নি তো?
মোটেও না। প্রায় কেউই তো জানে না!
জ্যাক ভাই নেই, এবার আমার কাছে কারও কোনও জিজ্ঞাস্যও নেই।
১৫.১০.২০১৪

No comments

Powered by Blogger.