ভারত-পাকিস্তান- সময় এসেছে এগিয়ে যাওয়ার by কুলদীপ নায়ার

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পুঁজিবাদেরই ফসল। নেহরুর আমলে যেমন সমাজতন্ত্রের একটা ব্যাপার ছিল, তাঁর আমলে সে রকম কিছু নেই। আবার মহাত্মা গান্ধীর স্বনির্ভরতারও কোনো কিছু তাঁর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মোদি যেকোনোভাবেই ভারতের উন্নয়ন চান, আর সেটা করতে গিয়ে ধনী ও গরিবের ব্যবধান বাড়লেও তাঁর কিছু আসে-যায় না। আমি এমন এক যুগের মানুষ, যখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে সমাজের নিচু কোটির মানুষের উন্নয়নই বোঝাত। আর আমি এটা বুঝি না, একটি দেশ বাম দিকে না ঘেঁষে কীভাবে উন্নত হতে বা তার গরিবদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, সমাজের জন্য যে সমাজতান্ত্রিক পথ আমরা বেছে নিয়েছিলাম, সেটাই সঠিক ছিল এবং আমাদের সে পথেই ফেরত যাওয়া উচিত। মোদির বক্তৃতার ভাষা খুবই সুনির্বাচিত, অনেকের কাছেই তা অনেক কিছু মনে হতে পারে—এমনকি শোনার জন্যও তা ভালোই। তিনি আসলেই একজন শক্তিমান বক্তা। কিন্তু আমরা কী করি, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
যেমন পরিকল্পনা কমিশনের কথাই ধরুন না কেন। প্রতিষ্ঠানটি যে একটি সমান্তরাল সরকারে পরিণত হয়েছে, সেটা সত্য। কিন্তু এতে যে আমলাতান্ত্রিক দ্বন্দ্ব রয়েছে, সেটা দূর করার চেষ্টা আমাদের করা উচিত। আমাদের মতো দেশগুলোর পরিকল্পনা থাকা উচিত, কীভাবে সম্পদের ব্যবহার করা হবে। তারপর প্রদেশগুলোর মধ্যে তার ন্যায়সংগত বিতরণ হওয়া উচিত। পরিকল্পনা কমিশনকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনা উচিত, প্রতিষ্ঠানটিকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না, মোদি যেটা করেছেন। মোদির সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফর নানাভাবেই সফল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি হয়তো দৃষ্টিগ্রাহ্য কিছু নিয়ে ফেরেননি, কিন্তু তিনি আত্মবিশ্বাসের একটি আবহ তৈরি করেছেন। আর ভারত ওয়াশিংটনের আস্থাও ফিরে পেয়েছে, যারা আগে ভারতের ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। যুক্তরাষ্ট্র মোদিকে একসময় ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানালেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বন্ধুত্বের বারতা পৌঁছে দিয়েছেন—মোদি এমনই এক ব্যক্তি।
বারাক ওবামার সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন মোদি, তাঁর পূর্বসূরিদের কেউই এতদূর যেতে পারেননি। এই প্রথমবারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যৌথভাবে মার্কিন সংবাদপত্রে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। নজির হিসেবে এটা ভালোই, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেরও উচিত এটা অনুসরণ করা। তবে এর মধ্য দিয়ে মোদি জওহরলাল নেহরুর জোট নিরপেক্ষ ধারণার অবসান ঘটিয়েছেন। তবে এই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বহু আগেই তার আবেদন হারিয়েছে। আর ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে কমিউনিস্টরা শীতল যুদ্ধে পরাজিত হয়। এখনো এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নেওয়ার কিছু আছে: বড় দেশগুলোর আকারের কারণে ছোট দেশগুলোর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তৃতীয় বিশ্বভুক্ত দেশগুলো সংখ্যায় মার্কিন ও সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।
ভারতে বামপন্থীদের প্রভাব বাড়েনি, এটা সত্যিই করুণার উদ্রেক করে। এর কারণ হচ্ছে, কমিউনিস্টরা ভারতকে বোঝে না। মার্ক্স গুরুত্বপূর্ণ, একইভাবে গান্ধীও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয়ে মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলসের ছবি থাকলেও গান্ধী বা নেহরুর ছবি সেখানে নেই। মোদি তাঁর প্রচারিত পুঁজিবাদের জন্য পরিকল্পনা কমিশন ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু এটা বাতিল করে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। একজন পাকিস্তানির ভাষ্যমতে, নওয়াজ শরিফ নিউইয়র্কে কাশ্মীরবিষয়ক ১৯টি বাক্য ব্যয় করলেও মোদি একটিও করেননি; সে জন্য ভারতে অনেকেই মোদির প্রশংসা করছেন। মোদি বক্তৃতায় কাশ্মীরের উল্লেখ পর্যন্ত করেননি। কিন্তু একটি সমস্যা উপেক্ষা করলেই সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় না। পাকিস্তানের সঙ্গে একই টেবিলে বসে ভারতকে শান্তিপূর্ণভাবে এই সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হবে। আজ হোক বা কাল, এ কাজ ভারতকে করতেই হবে। হুরিয়ত কাশ্মীরের প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলেও তারা ক্রমেই মৌলবাদী হয়ে উঠছে। এ কারণে তারা ভারত ও পশ্চিমে আবেদন হারাচ্ছে। হুরিয়তকে মানুষ মালা দিয়ে বরণ করত, যদি তারা সৈয়দ আলী শাহ গিলানিকে অব্যাহতি দিত। কারণ, তিনি বহুত্ববাদী ধারা পরিত্যাগ করে সংকীর্ণ ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছিলেন। ভারতে পাকিস্তানের হাইকমিশনার হুরিয়ত নেতাদের আমন্ত্রণ জানালে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশ থেকে বলা হয়েছে, ভারত একটু বেশি করে ফেলেছে—আমি এর সঙ্গে একমত। হুরিয়ত যখন বিচ্ছিন্নতাবাদের বিষয়ে কথা বলেছে, তখনো এরূপ আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ খুব পরিষ্কার ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানালেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকার পরিবর্তন হয়েছে, ফলে তার নীতিও বদলেছে।
মোদি ও সুষমা স্বরাজ অতীতে কী বলেছেন, তা আমি স্মৃতিচারণা করতে চাই, যাতে তাঁদের বর্তমান অবস্থান ও অতীতের অবস্থানের মধ্যে তুলনা টানা যায়। বেশ আগে নওয়াজ শরিফ প্রয়াত ইন্দর কুমার গুজরালের সঙ্গে আলোচনা শেষে বলেছিলেন, ‘আপনারা কাশ্মীর আমাদের হাতে তুলে দিতে পারেন না, আমরাও এমন কোনো অবস্থায় নেই যে তা আমরা গ্রহণ করতে পারি।’ শুধু তা-ই নয়, নওয়াজ শরিফ সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে কাশ্মীরবিষয়ক সমাধানে আসার জন্য ভারতের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন। সেনাবাহিনী তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল, সেটা অন্য ব্যাপার। কয়েক মাস তাঁকে অন্তরীণও করে রাখা হয়েছিল। কথা হচ্ছে, নওয়াজ শরিফ জাতিসংঘে কাশ্মীর নিয়ে কেন ১৯টি বাক্য খরচ করলেন? জাতিসংঘে কোনো পাকিস্তানি নেতার কাশ্মীরবিষয়ক এটাই সবচেয়ে দীর্ঘ রেফারেন্স। দৃশ্যত, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে তিনি একধরনের কায়েমি স্বার্থ সৃষ্টি করেছেন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জন্মগতভাবে ভারতবিরোধী, তারা নয়াদিল্লির সঙ্গে কোনো ধরনের ঐকমত্যে যেতে চায় না—পাকিস্তানে ক্ষমতার ঘুঁটি হিসেবে ভারত বিরোধিতাই এখনো সবচেয়ে কার্যকর!
নওয়াজ শরিফ সামরিক বাহিনী ও ডানপন্থীদের সমর্থনে ক্ষমতায় এলেও সেক্যুলারিজমের প্রতি তাঁর ঝোঁক রয়েছে। তিনি প্রমাণ করতে চান, ইসলামের সঙ্গে গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের কোনো বিরোধ নেই। আর সেক্যুলারিজম মানেই বহুত্ববাদ। তিনি কেন বদলে গেলেন? কোন পক্ষে তেল বেশি, সেটা কেন তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন? তিনি কখনোই আপস করেননি। আমার মনে হয়, যেসব ঝড়ঝঞ্ঝা তাঁর ওপর দিয়ে গেছে, সেসব থেকে তিনি কিছু শিক্ষা নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে মোদি এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন যে, বিজেপি এখন ক্ষণগণনা শুরু করেছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোয় তিনি যে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে অন্যান্য দেশের সরকারও তাদের এজেন্ডা নির্ধারণ করছে। এটা ভালো, তিনি পাকিস্তানের ব্যাপারে বৈরিতার মনোভাব পরিহার করেছেন। এখন দুই দেশের জন্যই সময় এসেছে, মনমোহন সিং যেখানে শেষ করেছেন, সেখান থেকেই তাদের শুরু করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.